অস্ত্রোপচারের পর ৪ প্রসূতির মৃত্যু, ঝুঁকিতে ৫ জন

চার রোগী মারা যাওয়ার পর বন্ধ ঝিনাইদহের মহেশপুরের জননী ক্লিনিক l ছবি: প্রথম আলো
চার রোগী মারা যাওয়ার পর বন্ধ ঝিনাইদহের মহেশপুরের জননী ক্লিনিক l ছবি: প্রথম আলো

ক্লিনিকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেওয়া চারজন প্রসূতি মারা গেছেন। জীবন সংশয়ে আছেন আরও পাঁচজন। মাত্র ৪০ দিনের মধ্যে এই মৃত্যু ও মৃত্যুঝুঁকির ঘটনাগুলো ঘটেছে।
জেলার মহেশপুর উপজেলার ভৈরবা বাজারে অবস্থিত জননী ক্লিনিক ও নার্সিং হোমে এই অস্ত্রোপচার করা হয়। ঘটনার পর ক্লিনিকটিতে তালা মেরে মালিক সটকে পড়েছেন। স্থানীয় প্রভাবশালীদের মাধ্যমে টাকা দিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি।
যে চার প্রসূতি মারা গেছেন তাঁরা হলেন মহেশপুর উপজেলার জাগুসা গ্রামের আক্তার আলীর স্ত্রী রুপা খাতুন (২০), অনন্তপুর গ্রামের আবদুস সামাদের স্ত্রী আরিফা খাতুন (১৮), কৃষ্ণচন্দ্রপুর গ্রামের নাজমুল ইসলামের স্ত্রী বিথি খাতুন (২০) ও জীবননগর উপজেলার বারান্দী গ্রামের ইউনুচ আলীর স্ত্রী সালেহা বেগম (২৬)।
মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকা প্রসূতিরা হলেন মহেশপুর উপজেলার গাড়াপোতা গ্রামের আলী কদর মোল্লার মেয়ে উম্মে সালমা, মাইলবাড়িয়া গ্রামের জহুরুল ইসলামের স্ত্রী পারভিনা খাতুন (২৫), বাগানমাঠ গ্রামের আবদুল আজিজের মেয়ে জেসমিন আক্তার (২৩), হুদাপাড়া গ্রামের আনিসুর রহমানের স্ত্রী নার্গিস খাতুন (২১), কাজিরবেড় ইউনিয়নের কোলা গ্রামের আবদুল আজিজের স্ত্রী পারুল খাতুন (২২)।
মৃত প্রসূতিদের স্বজনেরা বলেছেন, অস্ত্রোপচারে সন্তান জন্ম দেওয়ার পর এঁদের প্রত্যেকেই প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন। প্রত্যেককেই আবার হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাউকেই বাঁচানো যায়নি। এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি এঁদের শিশুরা।
জানতে চাইলে ঝিনাইদহের সিভিল সার্জন মো. আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, খবর পেয়ে তিনি ক্লিনিকটি পরিদর্শন করেছেন। ক্লিনিকটিতে অবেদন করার (অ্যানেসথেসিয়া) কোনো যন্ত্র তাঁর চোখে পড়েনি। অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার জন্য কোনো অটোক্লেভ মেশিনও তিনি দেখেননি। অস্ত্রোপচারকক্ষে মালপত্র স্তূপ করে রাখা ছিল। তিনি ধারণা করছেন, সংক্রমণ থেকে প্রসূতিদের মৃত্যু হয়েছে।
ক্লিনিকটির মালিক মো. মোমিনুর রহমান গা ঢাকা দিয়েছেন বলে সিভিল সার্জন দাবি করেছেন। একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে ক্লিনিকের মালিক মোমিনুর রহমান ওরফে খোকনকে মুঠোফোনে পাওয়া গেছে। তাঁর দাবি, ‘ওই এলাকায় আমার ক্লিনিকই সবচেয়ে ভালো। অবশ করা ওষুধে কোনো সমস্যা থাকতে পারে। আবার রোগীদের অন্য কোনো সমস্যা থাকতে পারে।’
মহেশপুর উপজেলার ভৈরবা বাজারে চারটি ক্লিনিক রয়েছে। তারই একটি জননী ক্লিনিক ও নার্সিং হোম। ১০ শয্যার এই ক্লিনিকে মাসে ১৮ থেকে ২০টি অস্ত্রোপচার হয় বলে জানিয়েছেন মালিক মোমিনুর রহমান। তিনি জানান, তিনি নিজেই এটা পরিচালনা করেন। একজন নার্স ও একজন আয়া ক্লিনিকে দায়িত্ব পালন করতেন। সার্বক্ষণিক কোনো চিকিৎসক ছিল না। মোমিনুর রহমান জানান, রোগী এলে চিকিৎসক ডেকে অস্ত্রোপচার করতেন। পরে রোগীর দেখভাল তাঁরাই করতেন।
ক্লিনিকটিতে অস্ত্রোপচার করতেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের চিকিৎসা কর্মকর্তা গোলাম রহমান ও ৩৩তম বিসিএসে নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসক মো. আসাদুজ্জামান। তবে এঁদের মধ্যে কে কোন রোগীর অস্ত্রোপচার করেছেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ দুই চিকিৎসক কখনো ক্লিনিকটি সম্পর্কে তাঁকে কিছু জানাননি বলে দাবি করেছেন সিভিল সার্জন। অস্ত্রোপচারের জন্য কোনোভাবেই উপযুক্ত নয়, এমন একটি ক্লিনিকে এই চিকিৎসকেরা কেন অস্ত্রোপচার করেছেন, তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসক গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অপারেশনের যন্ত্রপাতি ঠিকমতো দূষণমুক্ত না করায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি। ওই কারণেই রোগীদের মেনিনজাইটিস দেখা দিচ্ছে এবং মৃত্যু হচ্ছে।’ তিনি বলেন, আরও যাঁরা আক্রান্ত আছেন, তাঁদের বিষয়ে এখনো কিছু বলা যাচ্ছে না।
উপজেলার বালিনগর গ্রামের মৃত প্রসূতি রুপা বেগমের বাবা আবু বক্কর প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের দিন জননী ক্লিনিকে রুপার অস্ত্রোপচার হয়। ক্লিনিকে এক সপ্তাহ থাকার পর বাড়িতে ফিরেই তীব্র জ্বরে আক্রান্ত হন রুপা। কোনোভাবেই জ্বর ভালো হচ্ছিল না। তাঁরা রুপাকে আবার ওই ক্লিনিকে নিয়ে যান। ভালো না হওয়ায় সেখান থেকে তাঁকে নেওয়া হয় যশোর ২৫০ শয্যার হাসপাতালে। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেই ১৯ আগস্ট মারা যান রুপা।
আবু বক্কর বলেন, ‘দেড় লাখ টাকা ব্যয় করেও মেয়েকে বাঁচাতে পারিনি। আমরা গরিব মানুষ। এখন রুপার শিশুটির কী হবে ভেবে পাচ্ছি না।’
রুপার বিয়ে হয়েছিল মহেশপুর উপজেলার জাগুসা গ্রামের আক্তার আলীর সঙ্গে। মায়ের নামের সঙ্গে মিলিয়ে শিশুটির নাম রাখা হয়েছে রুহান।
ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ টাকা দিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও টাকা নেননি রুপার পরিবার। রুপার চাচা মসিয়ার রহমান বলেন, তাঁদের ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু নেননি। তিনি বলেন, ‘টাকা নয়, বিচার চাই আমরা।’
ভৈরবা গ্রামের আসাদুল হক মোল্লার একমাত্র কন্যা আরিফা খাতুন। অনন্তপুর গ্রামের আবদুস সামাদের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। আরিফার বাবা আসাদুল হক বলেন, ‘২৭ জুলাই জননী ক্লিনিকে সিজার করার পর আরিফার একটি মেয়ে সন্তান হয়। এক সপ্তাহ পর বাড়ি ফিরে আসে। বাড়িতে আসার পরই প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হয়।’ তিনি বলেন, তিনি মেয়েকে আবার ওই ক্লিনিকে নিয়ে যান। তাঁরা সমস্যা হবে না বলে কিছু ওষুধ দিয়ে আবারও বাড়ি পাঠিয়ে দেন। ক্রমে অবস্থা খারাপ হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। ২৪ আগস্ট সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরিফা মারা যান। আসাদুল হক নাতনির নাম রেখেছেন ছহিফা খাতুন।
আসাদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, মেয়ে মারা যাওয়ার পর তিনি বিচার চেয়েছেন। কিন্তু এলাকার কিছু ব্যক্তি জোর করে তাঁকে ৫০ হাজার টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে একটি সাদা স্টাম্পে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছেন। টাকা দেওয়ার সময় অন্যদের সঙ্গে বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ইমদাদুল হক উপস্থিত ছিলেন।
ইমদাদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামের অন্যরা থেকে ঘটনার মীমাংসা করেছেন। তাঁর উপস্থিতিতে লেনদেন হয়েছে মাত্র।
আসাদুল হক বলেন, ‘১ লাখ ৭ হাজার টাকা ব্যয় করেছি। তারা ৫০ হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়েছে। টাকাটা তারা যেভাবে দিয়েছে, সেভাবেই রেখে দিয়েছি। আমি বিচার চাই, টাকা চাই না।’
উপজেলার সাতপোতা গ্রামের বিথি খাতুন মারা গেছেন ২৭ আগস্ট রাতে খুলনার ২৫০ শয্যার হাসপাতালে। তাঁর বিয়ে হয়েছিল কৃষ্ণচন্দ্রপুর গ্রামের নাজমুল ইসলামের সঙ্গে। বিথি একটি পুত্রসন্তান জন্ম দিয়েছিলেন।
বিথি খাতুনের এক নিকটাত্মীয় নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাঁদের ৪৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে এবং স্টাম্পে মেয়ের অভিভাবকদের স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়া হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার বারান্দী গ্রামের ইউনুচ আলীর স্ত্রী সালেহা খাতুন ১ মাস ২০ দিন চিকিৎসা শেষে মারা যান। ইউনুচ আলী জানান, ১২ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল থেকে ফেরত দেওয়া হয়। সালেহাকে বাবার বাড়ি মহেশপুর উপজেলার গাড়াপোতায় নিয়ে যাওয়া হয়। বাবা আলী মোহাম্মদের বাড়িতে পরদিন ১৩ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়।
১ মাস ২০ দিনের শিশুকে রেখে মা চলে গেছেন। ছেলের নাম রাখা হয়েছে আবু সালাম। নানাবাড়িতে বড় হবে সে।
অসুস্থদের অবস্থা: অস্ত্রোপচারের পর গুরুতর অসুস্থ মহেশপুর উপজেলার গাড়াপোতা গ্রামের আলী কদর মোল্লার মেয়ে উম্মে সালমা (২৪)। প্রায় এক মাস যশোর কিংস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে শনিবার বাড়ি ফিরে এসেছেন তিনি। উম্মে সালমার ভাই এরশাদ আলী জানান, ১৪ জুলাই তাঁর বোনের অস্ত্রোপচার হয় জননী ক্লিনিকে। একটি ছেলে সন্তান হয় তাঁর। ছয় দিন পর বাড়ি ফিরে আসেন। বাড়িতে আসার তিন দিন পর অসুস্থ হয়ে পড়েন; ঘাড়ে যন্ত্রণা আর জ্বর। তাঁরা আবার তাঁকে ওই ক্লিনিকে নিয়ে যান। ক্লিনিক কর্তৃপক্ষÿজ্বরের ওধুষ দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু অবস্থার আরও অবনতি হলে যশোর কিংস হাসপাতালে নিয়ে যান। শনিবার বাড়ি নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, চিকিৎসকেরা বলে দিয়েছেন, এখন আল্লাহই একমাত্র ভরসা।
মাইলবাড়িয়া গ্রামের জহুরুল ইসলামের স্ত্রী পারভিনা খাতুনকেও (২৫) ফেরত দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। বাবা ইসরাফিল হোসেন জানান, তাঁর মেয়ে এতটাই অসুস্থ যে এখন আর হাসপাতালে নিতে পারছেন না। নিজ বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করাচ্ছেন। একটা কন্যাসন্তান হয়েছে পারভিনা খাতুনের। এখন তাঁকে নিয়ে একটাই দুশ্চিন্তা—শিশুটি কি মাতৃহারা হয়ে যাবে!
মহেশপুর উপজেলার বাগানমাঠ গ্রামের আবদুল আজিজের মেয়ে জেসমিন আক্তার (২৩) চিকিৎসাধীন আছেন ঢাকার মৌচাক এলাকার রাশমনো জেনারেল হাসপাতালে। ১৭ দিন আগে তাঁর সিজার করা হয় জননী ক্লিনিকে। রোগীর কাছে আছেন তাঁর বড় ভাই জয়নাল আবেদিন। তিনি প্রথম আলোকে টেলিফোনে বলেন, আইসিইউ থেকে শনিবার বাইরে বেডে দিয়েছেন। রোগীর অবস্থা ভালো না। তিনি জানান, বোনের কন্যাশিশুটি গ্রামের বাড়িতে আছে।
একইভাবে হুদাপাড়া গ্রামের আনিচুর রহমানের স্ত্রী নার্গিস খাতুন (২১) ভর্তি হয়েছেন যশোরের একটি ক্লিনিকে। কোলা গ্রামের আবদুল আজিজের স্ত্রী পারুলা খাতুনও (২২) যশোর একটি ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন বলে জানিয়েছেন ওই গ্রামের ইউপি সদস্য।
মহেশপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শাহীদুল ইসলাম শাহীন বলেন, এখনো কারও পরিবার থানায় অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে তাঁরা ব্যবস্থা নেবেন।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক দীন মো. নুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এ ধরনের কোনো তথ্য তিনি পাননি। তিনি ঘটনা খতিয়ে দেখে অভিযুক্ত ক্লিনিক মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। ওই ক্লিনিকে যেসব চিকিৎসক কাজ করতেন, তাঁদের ব্যাপারেও খোঁজখবর করবেন।