চোখে আছে আলো, তবু ওরা অন্ধকারে

বুধবার। সকাল পৌনে ১০টা। ঘরে মোটা পর্দা টানানো। এসি লাগানো ঘরটিতে এই দিনের বেলায়ও বেশ অন্ধকার। বিছানায় ঘুমাচ্ছে দুই ভাইবোন—মনীমুজ্জামান ও শ্রাবণী। 

বাবা তারেকুজ্জামান খানের ডাক শুনে মনীমুজ্জামান বিছানায় বসল। বসেই চোখে লাগাল সানগ্লাস। বাবার ডাক শ্রাবণীও শুনেছে। তবে ও চট করে বসতে পারল না। অনেকক্ষণ বালিশে মাথা নিচু করে রেখে চোখ কচলাতে লাগল। তারপর একসময় চোখে সানগ্লাস দিয়ে উঠে বসল।
রাজধানীর উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরে তারেকুজ্জামান ও লতিফা আক্তার দম্পতির বাসার নিত্যদিনের দৃশ্য এটি। তাঁদের ছেলেমেয়েরা সূর্যের আলো সহ্য করতে পারে না। তারা ঘুম থেকে জাগার পর অন্য বাচ্চাদের মতো দৌড়ে বারান্দায় যেতে পারে না। স্কুলে যাওয়ারও তাড়া নেই। শরীর যদি কোনো দিন খানিকটা ভালো ঠেকে তাহলেই কিছু সময়ের জন্য টেলিভিশনের সামনে বসতে পারে ওরা।
এই দম্পতির বড় মেয়ে শ্রাবণী জামানের বয়স ১১। আর ছেলে মনীমুজ্জামান খানের বয়স সাত বছর। ওরা দুজনই জন্মের পর দেড় বছরের মাথায় আক্রান্ত হয় ‘জেরোডার্মাপিগমেন্টোসাম’ নামক এক জটিল রোগে। ভারত ও বাংলাদেশের বড় বড় হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিয়েছেন, ওরা যত দিন বেঁচে থাকবে, তত দিনই ওদের সূর্যের আলো থেকে দূরে রাখতে হবে। ছেলেমেয়েদের আর কত দিন এভাবে ঘরের চার দেয়ালে অন্ধকারে বন্দী করে রাখবেন? এ ছাড়া উপায়ও নেই। একটি ঘরে এসি লাগিয়ে আলো ঢোকার পথ বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। বাড়ির অন্য ঘরগুলোতে দরজা, জানালা দিয়ে আলো ঢুকছে। এতেই ক্ষতি হচ্ছে দুই ছেলে-মেয়ের।
তারেকুজ্জামান বলেন, ‘ওদের একটু ভালো রাখার জন্য পুরো বাসায় সূর্যের আলো যাতে ঢুকতে না পারে সে ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। কিন্তু ভাড়াবাড়িতে এবং আর্থিক সামর্থ্যের অভাবে তা করা সম্ভব হচ্ছে না। চোখের সামনে ছেলে-মেয়ে দুটো শুধু কষ্টই পাচ্ছে।’
শ্রাবণী ও মনীমুজ্জামানের চোখ দুটো লাল হয়ে ফুলে আছে। সানগ্লাস পরেও মুখ তুলে বেশিক্ষণ কথা বলতে পারে না। মাথা নিচু করে খুব আস্তে করে কথা বলে। দুজনেরই মুখ, হাতসহ সারা শরীরে কালো ও সাদা ছোপ ছোপ দাগ। শ্রাবণীর শরীরে অসংখ্য ছোট ছোট গোটা বা মেজ হয়েছে। দুজনের চোখে ও চামড়ায় ধরা পড়েছে ক্যানসার। দিনে ছয় ঘণ্টা পর পর চোখে কৃত্রিমভাবে পানি তৈরি করতে ড্রপ দিতে হয়। চোখে আলাদা পর্দা পড়ে যায়, তখন অস্ত্রোপচার করতে হয়। দুবার ভারতে নিয়ে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। ফলোআপে আবার ভারতে যাওয়ার কথা ছিল। যাওয়া হয়নি।
তারেকুজ্জামান বলেন, ‘রোগটি ধরা পড়ার পর থেকে একদিনও নেই যে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হয়নি বা চোখের ড্রপ ছাড়া চলেছে। ভারতে গেলে দুই ছেলেমেয়ের পাশাপাশি আমাদেরও যেতে হয়। ওদের আলো থেকে বাঁচিয়ে ভারত নিয়ে যাওয়া, সেখানে থাকা, অস্ত্রোপচার করা সব মিলিয়ে সাত থেকে আট লাখ টাকার কমে সম্ভব হয় না। আমাদের পক্ষে তা করা আর সম্ভব হচ্ছে না।’
একটি এনজিওতে কাজ করতেন তারেকুজ্জামান। ছেলেমেয়ের জন্য কত ছুটি চাইবেন? প্রতিষ্ঠানই বা কত ছুটি দেবে? তাই চাকরিটি আর করা হয়নি। এখন ব্যক্তিগতভাবে আইটি ব্যবসা করছেন। লতিফা আক্তার গাজীপুরে সরকারি স্বাস্থ্য সহকারী হিসেবে কর্মরত। কর্মক্ষেত্র থেকেই বারবার ফোন করে দুই ছেলেমেয়েকে চোখে ড্রপ দেওয়ার কথা বলেন লতিফা। লতিফা বাসায় দুই ছেলেমেয়েকে দেখে রাখার জন্য নিজের বাবা, মা ও বোনকে এনে রেখেছেন।
তারেকুজ্জামান ও লতিফা ছিলেন খালাতো ভাই-বোন। তাঁদের বিবাহিত জীবন ১৪ বছরের।
মনীমুজ্জামানের বয়স কম। ও সারা দিন রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি দিয়ে খেলে। শ্রাবণীর কোনো বন্ধু নেই। বাইরে যেতে পারে না। ছোট ভাইয়ের সঙ্গে খেলায় মন বসে না। দুজনের দিন কাটে অনেকটা একাকিত্বের মধ্যে। বাবা, মা বাড়ি থাকলেও বাইরে যাওয়া যায় না। সন্ধ্যার দিকে যখন বাইরে সূর্যের আলো থাকে না, তখনই বাবার মোটরবাইকে মাঝে মধ্যে ঘুরতে বের হয় দুই ভাইবোন।
বড় হয়ে কী হবে—জানতে চাইলে মনীমুজ্জামান জানাল সে চিকিৎসক হতে চায়। কেন চিকিৎসক হতে চায়—জানতে চাইলে বলে, ‘আমার যে লাগব।’ তার ধারণা, সে চিকিৎসক হলে নিজের ও বোনের চিকিৎসা নিজেই করতে পারবে।
শ্রাবণীকেও একই প্রশ্ন করা হলে ও চুপ করে থাকে। হয়তো সে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু বলতে সাহস পাচ্ছে না। তার শরীর প্রায়ই হুট করে খারাপ হয়ে যায়। তখন দেয়ালে মাথা ঠুকে বসে থাকে। মাঝে মধ্যে চোখ ঝাপসা হয়ে যেখানে-সেখানে পড়েও যায়।
তারেকুজ্জামান বলেন, ‘স্কুল কর্তৃপক্ষ অভিভাবকদের সাদরে বরণ করে। আর আমাদের বেলায় উল্টো। কী যে কষ্ট তা বুঝিয়ে বলতে পারব না। রোগটি ছোঁয়াচে নয় বলার পর বাসার পাশের এক স্কুল মেয়েকে ভর্তি করতে রাজি হয়েছে। মেয়েকে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়েছে। হাত মোজা, পা মোজা, সানগ্লাস চোখে দিয়ে, পুরো শরীর ঢেকে মেয়ে মাঝে মধ্যে স্কুলে যায়।’
অনেক কষ্টের মধ্যেও তারেকুজ্জামান ও লতিফার চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। মেয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পায় না, তার পরও ক্লাসের পরীক্ষায় মেয়ে ভালো করে। ভালো গান গাইতে পারে। আঁকতেও পারে। কিন্তু তারপরই তাঁদের আক্ষেপ। যদি মেয়েকে ঘরে রেখেই গান শেখানো বা পড়ানোর ব্যবস্থা করতে পারতেন! কিন্তু তাতে যে অনেক খরচ।
প্রতি মাসে দুই ছেলেমেয়ের সাধারণ চিকিৎসার পেছনেই খরচ হয় ১০ হাজার টাকা। চিকিৎসকের কাছে নিতে হলে এসি গাড়ি ভাড়া করে তাতে চারদিকে কাগজ লাগিয়ে তারপর ওদের নিতে হয়। ঘণ্টা হিসাবে গাড়ির ভাড়া দিতে হয়। অন্যান্য খরচ তো আছেই। যখনই দরকার হচ্ছে পৈতৃক সম্পত্তি থেকে কিছু না কিছু বিক্রি করে খরচ মেটানো হচ্ছে। তাই বা আর কত দিন সম্ভব!
তারেকুজ্জামান দম্পতির দুই ছেলেমেয়ের রোগটি শনাক্তকরণ ও এখনো চিকিৎসা করছেন ইস্ট ওয়েস্ট মেডিকেল কলেজের চর্মরোগ বিভাগের প্রধান মো. জামাল উদ্দিন।
চর্ম ও লেজার বিশেষজ্ঞ জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই রোগে যারা আক্রান্ত হয় সূর্যের অতি বেগুনিরশ্মি তাদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শরীর ড্রাই হয়ে যায়। শরীরে কালো কালো ছোপ পড়ে। চোখে সমস্যা দেখা দেয়। আস্তে আস্তে তাদের চোখ ও চামড়ায় ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ে। উন্নত দেশেও এ রোগের চিকিৎসা নেই। তবে সেসব দেশ এসব রোগীর জন্য বিশেষ পর্দা, লাইট, ক্যাপসহ বিশেষ সুযোগ-সুবিধার পরিমাণ বাড়িয়ে তাদের কিছুদিন ভালো রাখতে পারে। এই রোগটি ভালো হবে না, শুধু যত দিন সম্ভব রোগীকে একটু ভালো রাখা।’
চর্মরোগ নিয়ে ১৩ বছরের চিকিৎসাজীবনে জামাল উদ্দিন এ পর্যন্ত বাংলাদেশে পাঁচ থেকে ছয়জন রোগীর কথা জানতে পেরেছেন বলে জানালেন। তাদের মধ্যে একজন মারা গেছে। অন্যদের অবস্থাও ভালো না। এ ধরনের রোগীরা খুব বেশি হলে ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচতে পারে।
জামাল উদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, ‘এই দম্পতিকে আমিই দ্বিতীয় সন্তান নিতে বলেছিলাম। সূত্র অনুযায়ী, চার সন্তানের মধ্যে একজনের আক্রান্ত হওয়ার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এঁদের ক্ষেত্রে সূত্র কাজ করেনি। এঁদের দুই সন্তান সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যাবে তাও বলার উপায় নেই। আবার সন্তান নিতে বলব সে সাহসও নেই।’
শ্রাবণী ও মনীমুজ্জামানের বাবা ও মা জানেন, তাঁদের দুই সন্তান খুব বেশিদিন হয়তো বাঁচবে না। তবে বাবা-মা হিসেবে সন্তানদের যত দিন পারেন একটু ভালো রাখতে চান। এজন্য সহযোগিতা চেয়েছেন এই দম্পতি।
এই বাবা ও মায়ের দিকে কেউ সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে চাইলে সহায়তা পাঠাতে পারেন এই নম্বরে। তারেকুজ্জামানের ডাচ-বাংলা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর-১৪৮১০৩৩৭৫২০ অথবা বিকাশ নম্বরে ০১৭১২২৬৩৮৯৬ (ব্যক্তিগত) সাহায্য করতে পারেন।