বাল্যবিবাহ বন্ধে আনোয়ারের লাল বাইসাইকেলে প্রচার

সকালে বিদ্যালয়ে যাচ্ছিল ছাত্রীরা। পথেই তাদের পেয়ে যান আনোয়ার হোসেন। এরপর বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে তাদের জানাতে লিফলেট তুলে দেন হাতে। গতকাল বগুড়ার সদর উপজেলার নুনগোলা উচ্চবিদ্যালয়ের কাছ থেকে ছবিটি তোলেন সোয়েল রানা
সকালে বিদ্যালয়ে যাচ্ছিল ছাত্রীরা। পথেই তাদের পেয়ে যান আনোয়ার হোসেন। এরপর বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে তাদের জানাতে লিফলেট তুলে দেন হাতে। গতকাল বগুড়ার সদর উপজেলার নুনগোলা উচ্চবিদ্যালয়ের কাছ থেকে ছবিটি তোলেন সোয়েল রানা

পেশায় কাঠমিস্ত্রি। বয়স ৫০ ছুঁই ছুঁই। তবে মনে তাঁর দৃঢ় প্রত্যয়। বাল্যবিবাহ বন্ধে সোচ্চার। এ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে লাল রঙের বাইসাইকেলে ৬৪ জেলায় ছুটে গেছেন। এবারের শীতে যাবেন ৫৫০টি উপজেলায়।
ব্যক্তি উদ্যোগে ‘বাল্যবিয়েমুক্ত বাংলাদেশ’ প্রচারে নামা উদ্যমী মানুষটির নাম আনোয়ার হোসেন। বাড়ি বগুড়ার সদর উপজেলার বারপুর গ্রামের উত্তরপাড়ায়। চলতি বছরের শুরুর দিকে তিনি বাল্যবিবাহবিরোধী প্রচারাভিযানে বের হয়েছিলেন লাল সাইকেলে চড়ে। ৬৭ দিনে গেছেন ৬৪ জেলায়। এ সময় তাঁর পরনে ছিল লাল পায়জামা, লাল জামা ও সোয়েটার। পায়ে ছিল লাল জুতা। সাইকেলের সামনের দিকে বাঁধা ছিল দুটি জাতীয় পতাকা ও একটি লাল পতাকা।
আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘রাস্তাঘাটে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, আমার সবকিছু এমন লাল কেন। জবাবে বলেছি, বাল্যবিয়ে পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র সবার জন্যই বিপজ্জনক। লাল পোশাক-সাইকেল-পতাকার মাধ্যমে আমি বোঝাতে চেয়েছি, বাল্যবিয়ে আসলেই বিপজ্জনক।’
অভাব-অনটনের কারণে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন আনোয়ার হোসেন। এরপর কাজ নেন বগুড়া শহরের একটি রেস্তোরাঁয়। দুই বছর পর চলে যান চট্টগ্রামে। সেখানে আগ্রাবাদ এলাকায় একটি আসবাবের দোকানে কাজ নেন। পরে বিয়ে করেন চট্টগ্রামের কদমতলী এলাকায়। থাকতেন পাঠানটুলি রোডে। সেখানে থাকতেই তাঁর স্কুলপড়ুয়া দুই ভাগনির বিয়ে হয়ে যায়। তখন ওদের বয়স ছিল যথাক্রমে ১৪ ও ১৫ বছর। পরে দুই বোনই স্বামী পরিত্যক্ত হয়ে ঢাকায় পোশাক কারখানায় চাকরি নেয়।
আনোয়ার বলেন, বাল্যবিবাহের শিকার দুই ভাগনির এমন করুণ পরিণতি তাঁকে পীড়া দেয়। এরপর থেকে খবরের কাগজে বাল্যবিবাহের সংবাদ দেখলেই খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। সংগ্রহ করতেন। বাল্যবিবাহ বন্ধে কিছু একটা করার কথা ভাবতেন। তিনি বলেন, দুই যুগ পর চট্টগ্রাম ছেড়ে তিনি কুমিল্লার দাউদকান্দি যান। সেখানে আসবাবের দোকান দেন। সেখানেও বাল্যবিবাহের নানা ঘটনা ঘটতে দেখেন। তাঁর মন খারাপ হয়। এরপর সিদ্ধান্ত নেন সাইকেলে ঘুরে ঘুরে বাল্যবিবাহবিরোধী প্রচার চালাবেন। দোকান বিক্রি করে পুরোনো একটি সাইকেল কেনেন। কিছু প্রচারপত্রও ছাপান। প্রথমে গত বছরের নভেম্বরে সেই সাইকেলে চেপে বেরিয়ে পড়েন। কুমিল্লা, ফেনী ও চট্টগ্রাম শহর ঘুরে মানুষের হাতে তুলে দেন বাল্যবিবাহবিরোধী প্রচারপত্র।
আনোয়ার বলেন, ‘কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পরিচয়পত্র দেখতে চান। প্রশাসনের কোনো অনুমতিপত্র আছে কি না, জানতে চান। ফেনীতে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি আমাকে এলাকায় ফিরে গিয়ে প্রশাসনের অনুমতিপত্র নেওয়ার পরামর্শ দেন।’
গত বছরের ডিসেম্বরে বগুড়ার সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে যান আনোয়ার। চেয়ারম্যানের সুপারিশের প্রেক্ষাপটে বগুড়ার তৎকালীন জেলা প্রশাসক শফিকুর রেজা বিশ্বাস তাঁকে প্রত্যয়নপত্র দেন। এতে লেখা, ‘বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ এবং এর কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে আনোয়ার হোসেন সাইকেলযোগে ৬৪ জেলায় উদ্বুদ্ধকরণ প্রচারাভিযানে বের হয়েছেন। জনসচেতনতামূলক এই উদ্যোগে তাঁকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হলো।’
আনোয়ার বলেন, এরপর কিছু প্রচারপত্র আর বাল্যবিবাহ-সংক্রান্ত সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনের ফটোকপি নিয়ে চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি বগুড়া থেকে নতুন করে বাল্যবিবাহবিরোধী সাইকেলযাত্রা শুরু করেন। এরপর ৬৭ দিনে তিনি ৬৪টি জেলায় প্রচার চালান। এই সময়ের মধ্যে জেলা প্রশাসকসহ বিশিষ্টজনদের কাছ থেকে লিখিত মন্তব্য সংগ্রহ করেন। সেখানে বগুড়া সদর আসনের সাংসদ নুরুল ইসলাম ওমর লিখেছেন, ‘এটা অনবদ্য উদ্যোগ। জেনে খুব খুশি হয়েছি।’ দিনাজপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আবু রায়হান মিয়া মন্তব্য করেছেন, ‘উদ্যোগটি প্রশংসনীয়।’ ঠাকুরগাঁওয়ের নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি) লিখেছেন, ‘এ ধরনের উদ্যোগ বাল্যবিবাহ রোধ করবে।’ চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর কবির লিখেছেন, ‘এই উদ্যোগের সাফল্য কামনা করছি।’ জাতীয় সংসদের সরকারি প্রতিষ্ঠান-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাংসদ শওকত আলী লিখেছেন, ‘শুভ উদ্যোগের নায়ক আনোয়ার হোসেনের কল্যাণ হোক।’ ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক শফিকুল ইসলাম লিখেছেন, ‘এই উদ্যোগ ও উদ্যোক্তার মঙ্গল কামনা করছি।’ মেহেরপুরের এনডিসি মো. আমীনুল ইসলাম লিখেছেন, ‘জনসচেতনতামূলক এই উদ্যোগ সকলের দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিবাচক পরিবর্তন বয়ে আনবে, এই প্রত্যাশা রইল।’
আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘গত বছরের ডিসেম্বরে বগুড়া সদরের একটি উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীর বিয়ে ঠিক করেন তার বাবা-মা। পরিচিত এক সাংবাদিকের সহযোগিতায় বিষয়টা প্রশাসনকে জানাই। পরে সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরাফাত রহমান ওই বাল্যবিয়ে বন্ধ করেন।’
আনোয়ার হোসেন এখন কাজ করেন বগুড়া শহরের একটি আসবাবের দোকানে। কোথাও বাল্যবিবাহের খবর পেলেই সেখানে ছুটে যান। বাল্যবিবাহের নানা খারাপ দিক ও পরিণতির কথা অভিভাবকদের কাছে তুলে ধরেন। সপ্তাহে অন্তত সাতটা সরকারি প্রাথমিক ও বালিকা বিদ্যালয়ে বাল্যবিবাহবিরোধী প্রচার চালান।
বগুড়া সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলী আজগর তালুকদার বলেন, একজন হতদরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের বাল্যবিবাহ বন্ধের এই প্রচেষ্টা সবার জন্য অনুপ্রেরণা জোগাবে। বাল্যবিবাহ বন্ধের এ রকম ফেরিওয়ালার হাত ধরেই একদিন ‘বাল্যবিয়েমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়া সম্ভব হবে।