আনন্দ-বেদনার বার্তা নিয়ে আসে প্রিজন ভ্যানগুলো

কারা ফটকের সামনে কোনো স্বজনকে দেখতে না পেয়ে প্রিজন ভ্যান থেকে টিস্যু পেপারে নিজের খালাস পাওয়ার সুখবরটি লিখে বাইরে ছুড়ে দিচ্ছেন এক জওয়ান  ছবি: প্রথম আলো
কারা ফটকের সামনে কোনো স্বজনকে দেখতে না পেয়ে প্রিজন ভ্যান থেকে টিস্যু পেপারে নিজের খালাস পাওয়ার সুখবরটি লিখে বাইরে ছুড়ে দিচ্ছেন এক জওয়ান ছবি: প্রথম আলো

আদালত থেকে একে একে প্রিজন ভ্যানগুলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফিরছে। কোনো ভ্যান থেকে খুশির চিৎকার আসছে। কেনোটির আরোহীরা একেবারেই নিশ্চুপ। কোনো ভ্যান থেকে ভেসে আসছে বিলাপ, কান্নার শব্দ।
এই চিত্রই কারাগারের সমনে উপস্থিত স্বজন আর গণমাধ্যমের কর্মীদের বলে দিচ্ছে পিলখানা হত্যা মামলার রায়ে প্রিজন ভ্যানে থাকা বিডিআর জওয়ানদের ভাগ্যে কী ঘটেছে।
গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকেই কারাগারের ফটকে ছিল উৎকণ্ঠায় থাকা স্বজনদের ভিড়। এক কিলোমিটার দূরে বকশীবাজারে স্থাপিত আদালতে তাঁদের স্বজনদের ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে।
বেলা সোয়া একটার দিকে আদালত থেকে বন্দীবাহী প্রথম প্রিজন ভ্যানটি কারা ফটকে এসে থামে। তার ১০ মিনিট আগে থেকেই পুলিশ ওই রাস্তায় হাঁটাচলাও বন্ধ করে দেয়। স্বজনদের সরিয়ে দেয় দূরে। র‌্যাবের দুটি গাড়ি পাহারা দিয়ে নিয়ে আসে প্রিজন ভ্যানটিকে। কারা ফটকের কাছাকাছি আসতেই প্রিজন ভ্যান থেকে চিৎকার ভেসে আসে ‘খালাস, খালাস’। ভ্যানের তারের জালির ছোট্ট ফোকরগুলো গলিয়ে আঙুল বের করে যে যেভাবে পারছে, নানা ইশারা করতে চেষ্টা করছে। সেই আঙুলের ইশারাতেই দূরে দাঁড়ানো স্বজনেরা হাত তুলে নিজেদের অবস্থান জানাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে পুলিশের বাধা আর স্বজনদের আটকে রাখতে ব্যর্থ হয়। স্বজনেরা কারা ফটকের পাশে এসে ভিড় জমায়। ফটকে ভ্যানটি ভেড়ানো ও ভ্যান থেকে বন্দীদের নামিয়ে কারাগারের ভেতরে নিতে সময় লাগে এক থেকে দেড় মিনিট। এটুকু সময়ই যেন অমূল্য। শুরু হয় দূর থেকে কথোপকথন।
নায়েক শামসুদ্দীনের স্ত্রী শাহিনা আক্তারও ঠেলাঠেলি করে ভিড়ের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ভ্যানের ভেতর থেকে চিৎকার আসে, ‘ও শামসু ভাবি, ভাই তো খালাস। আমিও খালাস। আমারে চিনছেন, আমি মোস্তফা। বাসায় একটু জানায় দিয়েন।’

স্বজনের মোবাইল নম্বর। সঙ্গে খালাস পাওয়ার খবর ষ ছবি: প্রথম আলো
স্বজনের মোবাইল নম্বর। সঙ্গে খালাস পাওয়ার খবর ষ ছবি: প্রথম আলো

স্বামীর খালাস পাওয়ার আনন্দে কেঁদে ফেলেন শাহিনা। এরপর তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেন পরিচিত বিডিআর সদস্যদের খবর জানতে।
ভ্যানটি খালি হতে না হতেই আবারও সাইরেন। আরেকটি ভ্যান এসে ভিড়ে ফটকে। আবারও চিৎকার, ‘সবাই খালাস’। তবে ফটকের কাছে আসতেই ভ্যানের ভেতর বন্দীদের চঞ্চল চোখগুলো অপেক্ষমাণদের মধ্যে স্বজনদের খুঁজতে থাকে। পরিচিতজনকে দেখা মাত্রই শুরু হয় ডাকাডাকি। হত্যা মামলায় খালাস পাওয়া এই বন্দীদের বেশির ভাগই বিদ্রোহের মামলাতে সাজা ভোগ করছেন।
যাঁরা পরিচিতদের খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তাঁদের কেউ কেউ টিস্যু পেপারে নিজেদের খালাস পাওয়া অথবা দণ্ডের বিবরণ আর স্বজনের ফোন নম্বর লিখে বাইরে ছুড়ে দিয়ে অন্যদের অনুরোধ করছিলেন একটি ফোন করে জানিয়ে দেওয়ার জন্য। কারারক্ষী ও দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরাও সদয় হয়ে বাইরে অপক্ষেমাণ কারও হাতে নম্বরটি তুলে দিচ্ছিলেন। তাঁরা ওই বিডিআর সদস্যদের স্বজনদের ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছিলেন দণ্ডের কথা।
এ রকমই একজন টিস্যু পেপারে ‘বিডিআর সিরাজ খালাস’ আর একটি ফোন নম্বর লিখে ভ্যান থেকে ছুড়ে দিলেন। সেই ফোন নম্বর ধরে আরেকজন ফোন করলে ওপাশে ফোনটি ধরেন সিরাজের মা রমিয়া বেগম। ছেলের নির্দোষ প্রমাণের খবর শুনে আনন্দে কাঁদতে শুরু করেন রমিয়া।
দুপুরের পর আসে আরও কয়েকটি প্রিজন ভ্যান। ভেতর থেকে তেমন সাড়াশব্দ নেই। এ রকম একটি ভ্যান থেকে ফেলা টিস্যুর চিরকুটে লেখা ‘৪০ বছর শাস্তি জাহাঙ্গীর আলম’ আর একটি ফোন নম্বর। ভিড় জমানো স্বজনেরা অন্যের খালাসের খবরগুলো দিতে যতটা আগ্রহী, দণ্ডের খবর দিতে ততটা আগ্রহী হচ্ছিলেন না। প্রিজন ভ্যান থেকে জাহাঙ্গীর চেয়ে আছেন ছলছল চোখে; বারবার বলছেন, ‘যা হওয়ার হইছে, ওদের বইলেন এখন দেখতে আসতে হবে না।’
আরেকটি ভ্যান আসে, একেবারেই নীরব। কাছাকাছি আসতে না আসতেই স্বামীকে দেখে ছুটে যান আয়েশা আক্তার নামে এক নারী। স্বামীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে জানতে পেরেই কাঁদতে কাঁদতে দৌড় দেন কারা ফটকের দিকে। নারী পুলিশ সদস্যরা তাঁকে ধরে ফেলেন। কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। খবর জানাতে স্বজনদের ফোন করছিলেন, কিন্তু কান্নার তোড়ে কিছুই বলতে পারছিলেন না।
নায়েব সুবেদার আলী আকবরের স্ত্রী রেহানা বেগম এসেছিলেন লাল জামা পরে। হাতে মেহেদি। দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, স্বামী খালাস পাবে। কিন্তু মিলেছে মৃত্যুদণ্ড। স্বামীকে বহনকারী ভ্যানটি আসার পর রেহানা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
তরুণ বিডিআর সদস্য এরশাদ আলীরও মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। এরশাদের বাবা আর্মড পুলিশ সদস্য। পঞ্চাশোর্ধ্ব বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না ছেলের এ পরিণতি। আশপাশের পুলিশ সদস্যরা তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, উচ্চ আদালতে আপিলের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বাবার মন তো মানে না।
ল্যান্স নায়েক মোস্তফা কামালের স্ত্রী পারভীন আক্তার আর ছেলে ফয়সাল বহুক্ষণ ধরে অপেক্ষা করেও কোনো খোঁজ জানতে পারছিলেন না। এর মধ্যে আদালতে মধ্যাহ্নভোজের বিরতি চলছিল। প্রায় দেড় ঘণ্টা কোনো ভ্যান আসছে না। পারভীন আক্তারের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। অঝোরে কাঁদছিলেন। বিকেল সোয়া চারটার দিকে ২৪ জনকে নিয়ে আসা শেষ ভ্যানটি হাসি ফোটাল পারভীনের মুখে। তাঁর স্বামী খালাস পেয়েছেন। স্বামীর সঙ্গে দূর থেকে কথাও বলতে পেরেছেন।
কিন্তু কারা ফটকে দাঁড়িয়ে থাকা বেশির ভাগেরই প্রিয়জনের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা জানতে পারেননি। তাঁরা ফিরে গেছেন একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে।