পলান সরকারের সঙ্গে কিছু সময়

পলান সরকার (ডানে) কথা বলছেন লেখক মলয় ভৌমিকের সঙ্গে। ছবি: শহিদুল ইসলাম
পলান সরকার (ডানে) কথা বলছেন লেখক মলয় ভৌমিকের সঙ্গে। ছবি: শহিদুল ইসলাম

হেমন্তের শুরু হলেও আকাশ ছিল মেঘলা। আগের রাতে ভারী বৃষ্টিও হয়েছে। ৩০ মিনিট রাজশাহী-নাটোর সড়ক ধরে এগোতেই সকালের গুমসোভাব অনেকটা কেটে গেল। ঈদের পরদিন। রাস্তা যতটা ফাঁকা থাকবে ভেবেছিলাম ততটা নয়। মূল সড়কে এত খুদে যানবাহন অন্য সময় চোখে পড়ে না। পুঠিয়া পৌঁছে গাড়ি নেমে গেল দক্ষিণের সড়কপথে। দিনে দিনে আরও বেশি বিবর্ণ হয়েছে পুঠিয়া রাজবাড়ি। এ বাড়ির সীমানা স্পর্শ করে পিচঢালা পথ গেছে বাঘা উপজেলার আড়ানি বাজারে। সেখানে পৌঁছে আবার ডান-বাঁয়ে দুটো পথ। আমরা যেতে চাই পলান সরকারের গ্রামে—তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, তিনি কেমন আছেন জানতে। কোন পথে এগোব? প্রথম আলোর আলোকচিত্র সাংবাদিক শহীদুল ইসলাম জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে একজন পথচারীকে জিজ্ঞেস করেন, পলান সরকারের বাড়ি—। প্রশ্ন শেষ না হতেই পথিক ডান দিকে ইঙ্গিত করেন। পলান সরকারের গ্রাম বাউসা থেকে আমরা তখনো ১২-১৩ কিলোমিটার দূরে। বোঝা গেল, অনেক দূরের মানুষের কাছেও তিনি পরিচিত। না, তিনি একুশে পদক পেয়েছেন বা পত্রিকায় তাঁর নাম-ছবি ছাপা হয়েছে বলে সবাই তাঁকে চেনেন, তা নয়। অনেক আগে থেকে নিজের কাজের জন্যই তিনি মানুষের পরিচয়ের সীমানায় পৌঁছে গেছেন।

রাস্তার দুই ধারে মাঝেমধ্যে আমন ধানের খেত। বেশির ভাগ জমিজুড়ে আমবাগান। প্রায় প্রতিটি বাগানে আমগাছের নিচে কোথাও হলুদগাছ, কোথাও আবার মাষকলাই। এখন মাষকলাই চাষের মৌসুম বটে। তবে আমবাগানে হলুদের চাষ বাঘার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য।

দেখতে দেখতে ১২ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে গেলাম। গাড়ি গিয়ে দাঁড়ায় রাস্তার কোল ঘেঁষে নির্মিত পলান সরকার পাঠাগারের ছোট্ট উঠোনে। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ। তিনি স্থানীয় মানুষ, ছাত্র-যুবকদের কাছে বেশ শ্রদ্ধেয়ও।

২০০৮ সালে রাজশাহী জেলা পরিষদের উদ্যোগে পলান সরকারের নিজস্ব জমির ওপরই নির্মিত হয়েছে পলান সরকার পাঠাগার। খুব বড় নয়। গ্রন্থতালিকা এবং বিষয়বৈচিত্র্যের হিসাবে তেমন সমৃদ্ধও বলা যায় না। ১০-১২টি কাঠের শেলফে কয়েক হাজার বই বুকে করে স্থির দাঁড়িয়ে আছে পাঠাগারটি। সেখানে দু-একজন পাঠক আসেন কি আসেন না ভাবতে ভাবতেই চলন্ত পাঠাগার পলান সরকার আমাদের সম্মুখে এসে দাঁড়ান। পরনে লুঙ্গি-ফতুয়া। সহজ-সরল-সাবলীল। তাঁকে দেখে কে বলবে ১৯২১ সালে পৃথিবীর আলো দেখা এই মানুষটি ৯৩ পেরিয়ে ৯৪ বছরে পা রাখলেন। হাঁটাচলা, কথা বলা সবই প্রায় স্বাভাবিক। মাথায় এখনো কিছু কাঁচা চুল সাদা চুলের অন্তরালে থেকে উঁকি দিচ্ছে। হাতে হাত মেলাতে মেলাতেই তিনি জানিয়ে দেন, ঝোলায় বই নিয়ে সাইকেলে চেপে গ্রাম থেকে গ্রামে আজও তিনি ঘুরে বেড়ান—এখনো তাঁর জন্য অপেক্ষায় থাকেন পাঠকেরা। তাহলে ইট-সিমেন্টের দেয়ালঘেরা স্থির দাঁড়িয়ে থাকা এই পাঠাগার? মুখোমুখি চেয়ারে বসা পলান সরকার প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর দেন না। হয়তো ভাবেন, কালের দীর্ঘ পথচলায় ব্যক্তি পলান সরকারকে একসময় স্থির হতেই হবে, তখন এই পাঠাগারই তাঁর হয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে নিয়ে যাবে জ্ঞানের বার্তা।

ভাসানযাত্রা থেকে গ্রন্থযাত্রা। প্রায় ৬৫ বছর ধরে বিরতিহীন সেই যাত্রা আজও চলছে। যৌবনের শুরুতে যাত্রাদল তাঁকে টেনেছিল। আজও সেই টানে কোনো ভাটা পড়েনি। গ্রামের তফির শাহের দলের সঙ্গে ভাসানযাত্রা, ইমানযাত্রা, কেষ্টযাত্রা (কৃষ্ণযাত্রা) নিয়ে সারা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। রামকৃষ্ণ দেব বলেছেন, ‘থ্যাটার করলে লোকশিক্ষা হয়’। হারেস উদ্দিন আহম্মদ নামান্তরে পলান সরকার কথাটা বিশ্বাস করেন। যাত্রাদলে নিজের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘চেহারা খারাপ ছিল বলে নায়ক-সহনায়কের পাট আমাকে দেওয়া হতো না। ফকরামো (ফক্কড়) বা লোক হাসানোর পাট করতে হতো আমাকে। কেউ অসুস্থ হলে বা অনুপস্থিত থাকলে সে পাটটা করার জন্যও প্রস্তুত থাকতে হতো। এভাবে করতে করতে একসময় প্রম্ট মাস্টারের দায়িত্ব পেয়ে যাই।’

পলান সরকার টানা ৩০-৩২ বছর গান-বাজনা, যাত্রা-থিয়েটারের মাধ্যমে মানুষকে শিক্ষিত-সচেতন করে তোলার কাজ করে গেছেন। এরই ধারাবাহিকতা থেকে একসময় তাঁর মনে হয় বই পড়ে মানুষ আরও তাড়াতাড়ি শিক্ষিত হতে পারে। তাঁর কথায় ‘জ্ঞানদান সব থেকে বড় দান’। সুতরাং তিনি আর বসে থাকেননি। যাত্রা-থিয়েটার করার পাশাপাশি আড়ানির ছাত্রবন্ধু লাইব্রেরি থেকে বই কিনতে শুরু করেন। নিজের পড়া শেষ হলে ব্যাগ ভর্তি করে সে বই পৌঁছে দিতে থাকেন বাড়ি বাড়ি। গত শতকের আশির দশকে চলন্ত পাঠাগার পলান সরকারের গ্রন্থযাত্রা শুরু হয় এভাবেই।

পাঠাগারের সম্মুখ চত্বরে বসে শিশুসুলভ সরলতায় পলান সরকার যখন তাঁর জীবনের নানা কথা বলে যাচ্ছিলেন, তখন ধীরে ধীরে সেখানে ভিড় বাড়তে থাকে। তাঁর সন্তানেরা যেমন এসে দাঁড়ান, তেমনি আসেন প্রতিবেশীরাও। আমাদের কথোপকথনের মধ্যে তাঁরাও যুক্ত হন। একটা বৈঠকি আবহ তৈরি হয়। পলান সরকারও উৎসাহী হয়ে ওঠেন। বই কেনার টাকা কোথায় পান? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ‘সংসারে সচ্ছলতা থাকলেও বই কেনার অভ্যাস বা সামর্থ্য ছিল না। একসময় রাস্তার কাগজ কুড়িয়েও পড়েছি। এ সময়ে ইউনিয়ন পরিষদের কর সংগ্রহের কাজটা পেয়ে গেলাম। সেখান থেকে যা আয় হতো, তা দিয়েই বই কিনেছি।’

পলান সরকারের জন্ম পার্শ্ববর্তী নাটোর জেলার বাগাতিপাড়ায়। মাত্র পাঁচ দিন বয়সে বাবার মৃত্যু হলে মায়ের সঙ্গে তিনি রাজশাহীর বাঘা থানার বাউসা গ্রামে নানাবাড়িতে চলে আসেন। চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। অথচ বাংলা ভাষার ওপর তাঁর চমৎকার দখল। জমির দলিল তৈরি, ব্যবসায়ের চুক্তিনামা, সভার কার্যবিবরণী—এসব কাজের জন্য এলাকার মানুষ তাঁর ওপর নির্ভরশীল। ‘গান-বাজনা করতে করতে, প্রম্ট করতে করতে আমার লেখাপড়া ঠিক হয়েছে।’ স্বশিক্ষিত হওয়ার পেছনের গল্পটা এভাবেই জানিয়ে দেন পলান সরকার। আর নিজ জীবনের এই অভিজ্ঞতার সূত্র ধরে তিনি উচ্চারণ করেন আরও এক গুরুত্বপূর্ণ কথা। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, মানুষকে আলোকিত করতে হলে গ্রামে গ্রামে পাঠাগার গড়ে তোলার পাশাপাশি যাত্রা-থিয়েটারও গড়ে তুলতে হবে।

আরজ আলী মাতুব্বরের মতোই পলান সরকারের নিজস্ব উপলব্ধিতে যুক্ত হয়েছে কাণ্ডজ্ঞানের দর্শন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, তথ্যের ওপর সবল শক্তির নিয়ন্ত্রণ এবং বর্তমান সময়ে তথ্যবিভ্রান্তির গোলকধাঁধা সম্পর্কে তিনি পুরোপুরি সচেতন। যেকোনো বই পড়লেই মানুষ আলোকিত হয় কি না—এ প্রশ্নের জবাবে তাই তিনি বলেন, ‘বই হলো এমন অস্ত্র, যা সৃষ্টির কাজে ব্যবহার হয়, আবার ধ্বংসের কাজেও ব্যবহার করা যায়। কাজেই এর ব্যবহারবিধিটাই আসল।’ ভালো বই পড়ার ওপর জোর দিয়ে তিনি আরও বলেন, বই শুধু পড়লেই হবে না—অসত্যের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজের শিক্ষাকে কাজে লাগাতে হবে। বই পড়ার পাশাপাশি মিছিলেও যেতে হবে। যত শিক্ষিত হোক, যত ভালো মানুষই হোক, কারও পক্ষে একা কিছু করা সম্ভব নয়। কাজেই সংঘবদ্ধভাবে সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে হবে।

সূর্য মাথার ওপর থেকে পশ্চিমে হেলতে শুরু করে। আগে থেকেই ঠিক ছিল আমরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাব। তাই আগে থেকেই তিনি দুপুরের খাবারের আমন্ত্রণও জানিয়ে রেখেছিলেন। বাড়ির ভেতরে ঢোকার মুহূর্তে দক্ষিণের পুকুরঘাটে গিয়ে দাঁড়াই আমরা। পলান সরকার জানান, গ্রামে একমাত্র তাঁর পুকুরেই গ্রীষ্মকালে পানি থাকে। পুকুরটি তিনি সবার জন্যই উন্মুক্ত রেখেছেন। বেশ কয়েক বিঘা জমির ওপর আধা পাকা বাড়ি। চারদিকে আমবাগান। অদূরে ৪০-৪৫ বিঘা আবাদি জমি। সেসব এখন বর্গা দেওয়া আছে। একসময় মায়ের তরফ থেকে পাওয়া নিজের সেই জমিতে কাজ করতেন পলান সরকার। লাঙল চষা, মই দেওয়া, নিড়ানি দেওয়া, ধান কাটা, মহিষের গাড়িতে করে সে ধান বাড়ির উঠোনে আনা, ধান মাড়াই করা—সব কাজেই তিনি সিদ্ধহস্ত। কোনো কাজই তাঁর কাছে ছোট নয়। পদক-পুরস্কারের আশায়ও কোনো কাজ করেন না। কেবল নিজের জন্য নয়, মানুষের জন্য কাজ করা যেকোনো মানুষের স্বাভাবিক দায়িত্ব—এই বোধ থেকেই কাজ করে যান পলান সরকার। আসলে এ দেশে শত বিপত্তির মধ্যেও মানুষের এগিয়ে চলা বোধ করি সম্ভব হচ্ছে পলান সরকারের মতো ব্যক্তিদের জন্যই।

আমাদের সঙ্গে খাবার টেবিলে একপাশে তিনিও বসেন। ৯৪ বছর বয়সী পলান সরকারের জন্য আলাদা কোনো আয়োজন নেই। স্বাচ্ছন্দ্যে সব খাবারই খেতে থাকেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে সুস্থ ও দীর্ঘায়ুর জন্য নিজেকে জটিল-কুটিল চিন্তা থেকে দূরে রাখা জরুরি বলে আমাদের মনে হতে থাকে।

পলান সরকার মানুষকে ভালোবাসেন। তাঁর এই ভালোবাসা, ব্যক্তিজীবনে সৎ থাকা বা প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার পেছনে যাত্রাদলের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি রাজনৈতিক দর্শনও কাজ করেছে।

পলান সরকারের মুখ থেকে আমরা এ কথাও জানতে পারি, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তিনি মিছিল করেছেন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানেও সক্রিয় ছিলেন তিনি। একাত্তর সালে পারিবারিক সমস্যার কারণে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে না পারলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা ও সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। খাবার টেবিলে বসে আমরা যখন এসব তথ্য জানছিলাম, তখন বাইরে পলান সরকার পাঠাগারে চলছিল অন্য এক আয়োজন।

বেলা তিনটা নাগাদ আমরা যখন পাঠাগারে এসে উপস্থিত হলাম, তখন অপরিসর সেই পাঠাগারে তিল ধারণের স্থানও ছিল না। মানব উন্নয়ন সংস্থা, কিশোর কলি, অনুশীলন ফাউন্ডেশন, কিশলয়, সেবার জন্য আমরা, ওরা এগারো জন, আড়ালের আর্তনাদ—এমন সব বাহারি নামের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের কাছে-দূরের কর্মীরা উপস্থিত হয়ে পাঠাগারকে প্রাণবন্ত করে তুলেছেন। না, এসব সংগঠন কোনো দাতা সংস্থার অর্থানুকূল্যে গড়ে ওঠেনি। পলান সরকারের এলাকা, সুতরাং যুবকেরা গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসাবেন কেন? প্রথম আলো প্রতিবেদক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ ওই সংগঠনের কর্মীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সংক্ষেপে তুলে ধরলেন তাঁদের কর্মকাণ্ড। বোঝা গেল এসব সংগঠন গড়ে ওঠার পেছনে তাঁর প্রেরণাও কাজ করেছে। ইতিমধ্যে সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছেন স্থানীয় বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। এসেছেন বাউসা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আশরাফ আলী, স্থানীয় কলেজের অধ্যক্ষ রেজাউল করিম, কবি ড. হাসান রাজা। সবাই কথা বললেন। আড্ডা আরও বেশি জমে উঠল, যখন এলাকার কণ্ঠশিল্পী রেজাউল করিম তাঁর দরাজ গলায় একে একে পুরোনো দিনের গান গাইতে থাকলেন।

সৃজনশীল সেই আড্ডার শেষ বক্তা ছিলেন পলান সরকার, যিনি দুপুরের খাওয়া শেষে কোনো বিশ্রাম না নিয়েই সাহসী যুবকের মতো উপস্থিত যুবকদের মধ্যমণি হয়ে বসেছিলেন। তাঁর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আমরা যখন পাঠাগারের সামনে রাস্তায় দাঁড়ানো গাড়িতে উঠে বসলাম তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে আরও ঢলে পড়েছে। চারদিকে শেষ বিকেলের ঝকঝকে রোদ—আমবাগানের মাথার ওপর চোখ গেলে দেখা যায় স্বচ্ছ উদার নীল আকাশ।

মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার