মানুষের কর্মোদ্যমই বাংলাদেশের প্রধান শক্তি

তেরেস ব্লঁশে
তেরেস ব্লঁশে

১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশের যে গ্রামসমাজের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে, তা এখন অতীতের গর্ভে বিলীন। জামালপুর জেলার গামারিয়া গ্রামটি ভৌগোলিক দিক থেকে ছিল ছোট্ট একটি জনপদ, কিন্তু তা যেন ছিল জনসম্পদে সমৃদ্ধ এক স্বয়ম্ভর পৃথিবী। তার পাড়াগুলো, তার সমাজ, আত্মীয়-পরিজনের যোগাযোগ খুব বেশি দূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল না; বাজার ও অর্ধ-সাপ্তাহিক হাটগুলো তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র।
গামারিয়ার যে পাড়ায় আমি থাকতাম, তার নাম উত্তরপাড়া। তখন ঢাকায় পড়ত এমন একটিও ছেলেমেয়ে ছিল না সে পাড়ায়। আমি চিনতাম তেমন মাত্র একজন লোকই ছিল যে বিদেশে কাজ করতে গেছে। দেওয়ানগঞ্জে জিল-বাংলা চিনিকল নির্মাণের সময় ওই এলাকার কিছু পুরুষ নির্মাণকাজে অংশ নিয়েছিল, যাদের অধিকাংশই ছিল উত্তরপাড়ার বাসিন্দা। সে জন্য উত্তরপাড়ার নাম হয়ে গিয়েছিল মিস্ত্রিপাড়া। এই মিস্ত্রিরা পরে অন্যান্য এলাকায় কাজে যায়, তাদের কেউ কেউ গোপনে দ্বিতীয় বিয়ে করে, আর প্রথম স্ত্রী যখন সেটা জানতে পারে, তখন ক্ষিপ্ত হয়।
প্রথম দিকে আমি ও আমার সন্তানেরা ছিলাম স্থানীয় লোকজনের সীমাহীন ঔৎসুক্য ও আগ্রহের বিষয়। আমার এখনো মনে পড়ে, হাটবারে একটি বাইসাইকেলের পেছনের সিটে এক বাচ্চাকে বসিয়ে, আরেকটিকে সামনের রডের ওপর নিয়ে, হ্যান্ডেলে ব্যাগ ঝুলিয়ে আমি বাজারের ভেতর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যেতাম। বাজারের জনসমুদ্রের মধ্যে ধীরে ধীরে একটা চিকন পথ খুলে যেত, লোকজন সরে গিয়ে আমাকে পথ করে দিত আর আমার দিকে এমন বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত, যেন তারা নিজেদের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না।
নৃবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা লাভের পর আমি বাংলাদেশে আসি নৃগোষ্ঠীবিষয়ক গবেষণায় নিজেকে নিয়োজিত করার লক্ষ্য নিয়ে। গবেষণার জন্য জামালপুর জেলার একটি গ্রাম বেছে নিই এ কারণে যে আমার স্বামী যুক্তরাজ্যের সেভ দ্য চিলড্রেন সংস্থার সিনিয়র মেডিকেল অফিসার হিসেবে বাংলাদেশে কর্মরত ছিলেন, তাঁর প্রকল্প এলাকার অন্তর্ভুক্ত ছিল ওই গ্রামটি। আমার মনে আছে, আমি যখন সিদ্ধান্ত নিই যে গবেষণার জন্য শিশুসন্তানদের নিয়ে গামারিয়াতে গিয়ে বসবাস করব, ওই সংস্থাটির লোকজন বলাবলি করেছিল, মহিলার মাথা নিশ্চয়ই খারাপ, নইলে এত ঝুঁকি ও ঝামেলার মধ্যে এমন অজপাড়াগাঁয়ে বাচ্চাকাচ্চাসহ থাকার কথা কেউ চিন্তা করতে পারে? কিন্তু আমি সেসব কথায় মোটেও কান দিইনি। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। আজ আমি জানি, তার ফলে কত উপকৃত হয়েছি।

সেই গামারিয়া, বাংলাদেশের সেই গ্রামীণ ভুবন আজ আর নেই, হারিয়ে গেছে চিরতরে। কিন্তু আমার স্মৃতিতে তা রয়ে গেছে অমূল্য মণিরত্নের মতো। ঢাকা শহরের আজকের তরুণ সমাজের পক্ষে হয়তো বা সেই ভুবনের কল্পনা করাও কঠিন। বিদ্যুৎ ছিল না, ফোন ছিল না, টেলিভিশন ছিল না। শুধু ট্রেন চলাচল করত, কিন্তু সে ট্রেন কখন আসবে আর কখন যাবে তারও কোনো ঠিক-ঠিকানা ছিল না। গামারিয়া থেকে ঢাকার দূরত্ব আমার কাছে মনে হতো যেন ঢাকা ও প্যারিসের দূরত্বের মতো। সময়টা ছিল ১৯৭৯।

এখন গামারিয়ার মানুষ টেলিভিশন দেখে। ঢাকার লোকেরা যেসব টিভি সিরিয়াল দেখে, তারাও সেসব দেখতে পারে। তাদের হাতে হাতে এখন মোবাইল ফোন; পড়াশোনা, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য যারা দূরে গেছে, যারা আসা-যাওয়ার মধ্যে আছে, সবার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। অসুবিধা একটাই, ইন্টারনেট সংযোগ এখনো সবখানে পৌঁছেনি, গতিও ভালো নয়।

গামারিয়ার অনেক নারী ও পুরুষ এখন পোশাক কারখানাগুলোতে কাজ করে। গত এপ্রিল মাসে সাভারের রানা প্লাজা ধসে যেসব পোশাককর্মী মারা গেছে, তাদের মধ্যে গামারিয়ার পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর অনেকেই ছিল। গামারিয়ার অনেকে কাজ করতে গেছে মধ্যপ্রাচ্যে এবং অন্যান্য দেশে। আমার পরিচিত একটি ছেলে বড় হয়ে হাইতি ঘুরে এসেছে। সে হাইতি গিয়েছিল জাতিসংঘ শান্তি মিশনের সদস্য হিসেবে। কিছুদিন আগে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, সেখানে সে কয়েকটি ফরাসি শব্দ শিখেছে, গর্বের সঙ্গে সেগুলো উচ্চারণ করল। হাইতির ভাষা ফরাসি; আমারও মাতৃভাষা তা-ই। গামারিয়ায় শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে অনেক, যুবসমাজের জানাশোনা ও চলাফেরার জগতের ব্যাপ্তি বেড়েছে, দেশের ভেতরে-বাইরে যাওয়া-আসাও বেড়েছে। এককথায়, একসময়ের সীমিত গণ্ডি আজ অনেক প্রসারিত হয়েছে। তরুণ-যুবসমাজের পোশাক-আশাকেও পরিবর্তন এসেছে, হালের ফ্যাশন তাদেরও স্পর্শ করেছে; কাঙ্ক্ষিত শহুরে জীবনপ্রণালি তাদের মনেও নতুন আশা-প্রত্যাশা-স্বপ্নের জন্ম দিয়েছে।

দীর্ঘ সময় ধরে এই দেশে বসবাস, গবেষণাকাজের সুবাদে বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে যাওয়া, গ্রামের মানুষের সঙ্গে মেলামেশার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে আমার মনে এই উপলব্ধি জাগে যে বাংলাদেশের গ্রামগুলো সব এক রকম নয়। গামারিয়ার কথা বললে, সেটি নিজেই এক স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম, কিন্তু মোটেও বাংলাদেশি গ্রামের কোনো মডেল নয়। ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ও জলবায়ুতে পার্থক্য আছে; সামাজিক গঠন, স্থানীয় ইতিহাস, রীতি-ঐতিহ্য ইত্যাদির বৈচিত্র্য গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশে অনেক গ্রামাঞ্চল ছিল, বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যাদের যোগাযোগ ছিল গামারিয়ার চেয়ে বেশি। শিক্ষাদীক্ষায় গামারিয়ার চেয়ে অগ্রসর, আরও বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গ্রামগঞ্জ সেই সময় অনেক ছিল। বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে চমৎকার দক্ষতাপূর্ণ লোকজন ছিলেন, যাঁরা নিজেদের বিশেষ ধরনের কর্মকাণ্ড দ্বারা নিজেদের এলাকাকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন।

একটি গ্রামে গবেষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের যে ছবিটি আমার মনে গাঁথা হচ্ছিল, সেই ছবিটি বিচারি-দৃষ্টিতে পুনর্বিবেচনা করতে করতে বাংলাদেশ সম্পর্কিত বিভিন্ন গবেষণায় উঠে আসা প্রধান ধারণাগুলো আমার মনে ভেঙেচুরে গিয়ে নতুনভাবে, ভিন্নভাবে গড়ে উঠতে শুরু করে। এ প্রসঙ্গে গবেষণার দুটি ক্ষেত্র আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়: পতিতালয় ও পতিতাবৃত্তি এবং নারী-শ্রমিকদের বিদেশে কাজ করতে যাওয়া। গবেষণার জন্য আমি এমন কিছু বিষয় বেছে নিই, যেগুলো অস্বস্তিপূর্ণ, এখানকার ভদ্রসমাজে যা নিয়ে কথা বলা যায় না, যেগুলো গোপনীয়, নিষিদ্ধ, ট্যাবুর মতো। কিন্তু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নিয়ে প্রচলিত নীরবতা আবার খুব দ্রুতই বদলে যেতে পারে। অভিবাসী নারী-শ্রমিকদের বেলা এটা ঘটেছে। গণমাধ্যমে তাঁদের ব্যাপারে আগ্রহ লক্ষ করা গেছে, তাঁরা কখনো কখনো চাঞ্চল্যের কারণও হয়েছেন। তবে নেতিবাচক অর্থে: অন্যায়-অবিচার, নির্যাতন-হয়রানির শিকার হিসেবে, শত বাধা-বিপত্তি-প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তাঁরা যে কিছু অর্জন করেন সে জন্য নয়। অভিবাসী নারী শ্রমিকদের অর্থনৈতিক অবদান সাধারণভাবে উপেক্ষিত হয়ে আসছে।

গবেষণার জন্য এসব বিষয় বেছে নেওয়ার পেছনে রয়েছে আমার নিজেরই ভাবনা এবং এসব বিষয়ে আমার ভাবনা নিরপেক্ষ-নৈর্ব্যক্তিক নয়, যেমন নিরপেক্ষ নয় প্রতিটি সমাজের প্রবল অভিমতগুলো। আমার আগ্রহের আংশিক কারণ এক ধরনের প্রতিক্রিয়া; আমি দেখেছি, এই সমাজে নারীর ব্যক্তিচরিত্রের বিশুদ্ধতাকে বানানো হয়েছে শ্রদ্ধা-সম্মানের মানদণ্ড। নারীর আপাত বিশুদ্ধতার নিরিখেই তৈরি করা হয়েছে ‘পতিত’ নারীর ধারণা। এই সামাজিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আমি প্রতারণা দেখতে পাই। এসব নিয়ে আমার গবেষণায় আত্মনিয়োগ করার পেছনের প্রণোদনা অংশত সেটারই প্রতিক্রিয়া। দুঃখজনকভাবে, এ বিষয়টি বিশদভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার সুযোগ এই স্বল্প পরিসরে নেই।

যখন ভাবি, বাংলাদেশকে বোঝার ক্ষেত্রে এখানকার একটি গ্রামে আমার প্রথম অভিজ্ঞতার তাৎপর্য কী ছিল, তখন বুঝতে পারি যে ওই সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে উন্নয়ন সংস্থাগুলোর ব্যাপারে আমার সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি আরও জোরালো হয়েছে। বিশেষত এই প্রসঙ্গে যে, তারা এই সমাজের সব স্থানীয় সমস্যার পাইকারি সমাধান বাতলে দিতে চায়; এই সমাজ সম্পর্কে তারা কতটা অজ্ঞ সেটা তারা নিজেরাই জানে না, অন্ধের মতো বাঁধা গৎ ধরে এ সমাজের যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট, সমস্যা-সংকটের দায় চাপিয়ে দেয় সামাজিক রীতিনীতি আর ‘ঐতিহ্যে’র ওপর। ঢাকাকেন্দ্রিক অভিজাত গবেষক-বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গিও অনেকটা একই রকম নেতিবাচক।

বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার যেটুকু বুঝ, তা গড়ে উঠেছে ধানচাষিদের জীবনপ্রণালিকে কেন্দ্র করে, যারা বাস করে একটা বিশেষ পরিবেশগত বলয়ের মধ্যে। এই প্রাকৃতিক পরিবেশ, এর ঋতুচক্র এবং কৃষিকর্মের চক্রাকার প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠা ধারণা-প্রতীকগুলো নিয়ে আমার কাজ। দুটি ধারণা-প্রতীকের প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ: লক্ষ্মী (সম্পদ: এখানে সম্পদ হচ্ছে ভূমি) আর গঙ্গা (পানি); এ দুইয়ের সম্পর্কের মধ্যকার টানাপড়েন। স্বাভাবিক বর্ষায় যে পানি ভূমিকে ফসল ফলানোর উপযোগী করে; সে পানিই আবার হঠাৎ প্রলয়ংকরী বন্যার রূপ নিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। আমার মনে হয়, এই সমাজে সম্পদ-সমৃদ্ধির ধারণা এবং আকস্মিক ভাগ্য পরির্বতনের ব্যাখা-বিশ্বাসগুলোর সঙ্গে চাষিদের অর্থনৈতিক জীবনের নিবিড় সম্পর্ক আছে, যা আধুনিক অর্থনীতিকে অতিক্রম করে যায়। চাষির লক্ষ্মী বা সম্পদের ধারণায় এক নৈতিক মাত্রা, যা মুনাফাতাড়িত পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে অনুপস্থিত।

একটি কথা না বললেই নয়। প্রাকৃতিক ও মানুষের তৈরি দুর্যোগ-দুর্বিপাকের ঘন ঘন শিকার বাংলাদেশ। এর শাসনব্যবস্থাও খুব একটা স্থিতিশীল নয়। বাংলাদেশের প্রধান শক্তিমত্তা হচ্ছে জনগণের কর্মোদ্যম ও কষ্টসহিষ্ণুতা এবং সমাজ নামের প্রতিষ্ঠানটির শক্ত বুনিয়াদ। সমাজই এই জাতির প্রাণ। গ্রামীণ সমাজকে অন্য অর্থে ঝগড়াপুরও বলা যায়, তবু সেখানে আশাবাদের অনেক কিছু আমি দেখতে পাই।

ইংরেজি থেকে অনূদিত