আ.লীগে তরুণ প্রভাবশালীরা এগিয়ে

পৌরসভা নির্বাচন
পৌরসভা নির্বাচন

বয়সে তরুণ, এলাকায় প্রভাব আছে, মন্ত্রী-সাংসদের আত্মীয় ও টাকাওয়ালা—এই চার শ্রেণির প্রার্থীরাই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বেশি পেয়েছেন। ২৫টি পৌরসভায় খোঁজ নিয়ে অন্তত ১৮টিতে এই শ্রেণির প্রার্থী পাওয়া গেছে।
তবে মনোনয়ন পাওয়া ব্যক্তিরা হঠাৎ এসে দলের আনুকূল্য পাননি। এঁদের বেশির ভাগেরই দলে পদ আছে, কেউ কেউ বর্তমান বা সাবেক মেয়র এবং প্রচারে মাঠে আছেন ভালোভাবেই। সদ্য সাবেক ছাত্রলীগ ও যুবলীগ এবং বর্তমান যুবলীগের বেশ কয়েকজন নেতাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তবে মনোনয়নে ক্ষুব্ধ অনেকেই স্বতন্ত্র নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। স্থানীয় পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে।
দলীয় সূত্র জানায়, মঙ্গলবার রাতেই দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা ২৩৫ পৌরসভার প্রার্থীদের মনোনয়নের চিঠিতে সই করেন। রাতেই প্রার্থীর হাতে ও প্রতিনিধির মাধ্যমে তা বিলি করা হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের দপ্তর থেকে গতকাল রাত পর্যন্ত প্রার্থীদের আনুষ্ঠানিক তালিকা প্রকাশ করা হয়নি।
জানতে চাইলে দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্রে দেওয়া নামের সঙ্গে তৃণমূল থেকে পাঠানো নামের বানানে ভুল ছিল। এগুলো সংশোধন করতে সময় লাগছে।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রী-সাংসদ ও তৃণমূলের নেতারা প্রার্থী বাছাইয়ে নিজেদের পছন্দ-অপছন্দকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। দলীয় সভানেত্রী ও জ্যেষ্ঠ কয়েকজন নেতা এর ওপর তাঁদের নিজস্ব বিবেচনা প্রয়োগ করেছেন। তবে একজন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যসহ তিন-চারজন কেন্দ্রীয় নেতা প্রার্থী মনোনয়নে দলীয় সভানেত্রীকে কিছুটা প্রভাবিত করতে পেরেছেন বলেও জানা গেছে।
একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, শরীয়তপুরে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি রফিক কোতোয়ালকে অনেকটা ডেকে এনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। ফেনীতে জাতীয় পার্টি থেকে দলবদল করে এসেই আলাউদ্দিন মনোনয়ন পেয়েছেন। তিনি স্টার লাইনের মালিক এবং ‘টাকাওয়ালা’ প্রার্থী হিসেবে পরিচিতি।
জাতীয় পার্টি থেকে এসে অনেকেই মনোনয়ন পাননি। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে অর্থবিত্ত বড় ভূমিকা রেখেছে—এমন অভিযোগের জবাবে আলাউদ্দিন বলেন, ‘আমার টাকা আছে বলে হিংসায় কেউ কেউ বলতে পারে। তবে শুধু টাকা দিয়ে হয় না। যোগ্যতা, সমর্থন ও যোগাযোগ থাকতে হয়।’ তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আমার মতো প্রার্থী খুঁজছিল। আর আমারও মুক্তিযুদ্ধের দল আওয়ামী লীগে যাওয়ার দরকার ছিল। দুই মিলে হয়ে গেছে। জেলা ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগকে ধন্যবাদ।’
নেত্রকোনায় জনপ্রিয় মেয়র প্রশান্ত কুমার রায়কে বাদ দিয়ে ‘অর্থবিত্ত ও পারিবারিক প্রভাবের কারণে’ নজরুল ইসলাম খান দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। রূপগঞ্জে শিল্পপতি ও সাংসদ গোলাম দস্তগীর গাজীর স্ত্রী হাসিনা গাজী মনোনয়ন পেয়েছেন। ‘প্রভাব ও সম্পদশালী’ হিসেবে তিনি বিবেচনায় এসেছেন।
বঞ্চিতরা স্বতন্ত্রের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন: নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, বরগুনা, রাজবাড়ী, সাতক্ষীরা, নীলফামারী, গাইবান্ধাসহ বিভিন্ন জেলার অন্তত ১০টি পৌরসভায় মনোনয়নবঞ্চিতরা স্বতন্ত্র নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বরগুনার বেতাগীতে গতকাল হরতাল পালন করেছেন বঞ্চিতরা। বিক্ষোভ হয়েছে কিছু কিছু স্থানে।
বরগুনা সদরে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হুমায়ুন কবির ও বেতাগীতে উপজেলা সভাপতি এ বি এম গোলাম কবিরের নাম তৃণমূল থেকে প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু সদরে জেলা যুবলীগের সভাপতি কামরুল হাসান ও বেতাগীতে আলতাফ হোসেন বিশ্বাসকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। সদরে বর্তমান মেয়র শাহাদাত হোসেন ও সাবেক মেয়র মো. শাজাহানও আগ্রহী ছিলেন। তাঁদের নাম তৃণমূল পাঠায়নি, কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ডও মনোনয়ন দেয়নি। এখন দুজনই স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন বলে জানা গেছে।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ পৌরসভার বর্তমান মেয়র সাদেকুর রহমানের নাম তৃণমূল থেকে এককভাবে প্রস্তাব করা হয়েছিল। আর আড়াইহাজারের সাংসদ নজরুল ইসলাম ওরফে বাবু নিজে জমা দেন তাঁর বোনজামাই ফজলে রাব্বীর নাম। শেষ পর্যন্ত সাংসদের বোনজামাই মনোনয়ন পেয়েছেন।
সাদেকুর রহমানের ঘনিষ্ঠজনেরা জানিয়েছেন, তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন। গত নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন।
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়াতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা কমিটির বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক কামরুল ইসলাম চৌধুরী। এখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন ধর্মবিষয়ক সম্পাদক শাজাহান শিকদার। অবশ্য তৃণমূল থেকে দুজনের নামই পাঠানো হয়েছিল।
কামরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পৌরবাসীর স্বার্থে আমি স্বতন্ত্র নির্বাচন করব। দীর্ঘদিন রাজনীতি করছি, মানুষের পাশে থাকছি। তাঁরাই আমার সব।’
সাতক্ষীরা সদরে মনোনয়ন পেয়েছেন শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদত হোসেন। কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থীর হিসেবে গতকাল মনোনয়নপত্র কিনেছেন দুবারের মেয়র শেখ আশরাফুল হক। অবশ্য তৃণমূল থেকে প্রস্তাব করা হয়েছিল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলামের নাম। তিনিও মনোনয়ন পাননি।
আশরাফুল হক বলেন, দলের তৃণমূলের মতামত না নিয়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন।
রাজবাড়ীর পাংশায় দলের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে আবদুল্লা আল মাসুদ বিশ্বাসকে। কিন্তু পৌর সভাপতি ও বর্তমান মেয়র ওয়াজেদ আলী মণ্ডল প্রার্থী হবেন বলে জানিয়েছেন তাঁর ভাই ফরিদ হাসান অদুদ।
রাজবাড়ী সদরে সাংসদ কাজী কেরামত আলীর ভাই এরাদত আলীকে একক প্রার্থী হিসেবে প্রস্তাব করেছিল তৃণমূল। কিন্তু সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ কামরুন্নাহার চৌধুরীর স্বামী মহম্মদ আলী চৌধুরী মনোনয়ন পেয়েছেন। এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে এরাদত আলী স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন।
বিদ্রোহী প্রার্থীর বিষয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘বড় দলে প্রচুর যোগ্য প্রার্থী থাকে। বাদ গেলে তো ক্ষুব্ধ হবেই। তবে দুই-এক দিন পরে রাগ কমে যাবে।’
দ্বন্দ্বে নতুন মাত্রা: শরীয়তপুর সদরে বর্তমান মেয়র আবদুর রব মুন্সীকে বাদ দিয়ে সেখানে দেওয়া হয়েছে ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সহসভাপতি রফিক কোতোয়ালকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রফিক কোতোয়াল প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ দেখাননি। ২০০৮ ও ২০১৪ সালে শরীয়তপুর সদর আসন থেকে সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ দেখিয়ে কেন্দ্রে তদবির করেছিলেন। কিন্তু এবার সেখানে সাংসদ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুটি পক্ষের দ্বন্দ্বের কারণে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য রফিককে টেনে আনেন। রফিক ওই কেন্দ্রীয় নেতার ঘনিষ্ঠ।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় সূত্র জানায়, শরীয়তপুরে তৃণমূল আওয়ামী লীগ পাঠিয়েছে আবদুর রব মুন্সীর নাম। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও। তবে একটি স্কুলের সভাপতি হিসেবে আর্থিক দুর্নীতির দায়ে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছিলেন তিনি। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সদর আসনের সাংসদ বি এম মোজাম্মেল হক পাঠিয়েছেন নুরুল আমিন কোতোয়ালের নাম। ওই খানে বি এম মোজাম্মেলের সঙ্গে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ইকবাল হোসেনের দ্বন্দ্ব রয়েছে।
নীলফামারীর সৈয়দপুরে মনোনয়ন পেয়েছেন কলেজশিক্ষক শাখাওয়াত হোসেন। প্রার্থী ছিলেন রংপুর শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আকতার হোসেন ও হিটলার চৌধুরীরও। সর্বশেষ পৌর নির্বাচনে এই তিন প্রার্থীই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। দলের সমর্থন পেয়েছিলেন আকতার হোসেন। বাকি দুজনও নির্বাচন করেন। এবার মনোনয়ন পেলেন শাখাওয়াত। দেখার বিষয় বাকি দুজন এবার কী করেন।
যশোর সদর পৌরসভায় মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীন চাকলাদারের চাচাতো ভাই জহিরুল ইসলাম চাকলাদার। জেলা সভাপতি শহিদুল ইসলাম আলাদা তালিকায় সাবেক মেয়র এস এম কামরুজ্জামানের নাম পাঠান। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে দ্বন্দ্বে শাহীন চাকলাদারই জয়ী হয়েছেন।
লাঙল ছেড়ে নৌকায়, অতঃপর: নীলফামারীর জলঢাকায় মনোনয়ন পেয়েছেন আবদুল ওয়াহেদ বাহাদুর। তিনি বর্তমানে উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান। এই পৌরসভার বর্তমান মেয়র ইলিয়াস হোসেন ছিলেন জাতীয় পার্টির। গত ২৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন নৌকাও গেছে, লাঙলও গেছে।
জানতে চাইলে ইলিয়াস হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ওপরের সংকেত পেয়েই দলে যোগ দিয়েছিলেন। এখন কর্মী ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে স্বতন্ত্র নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেবেন।
মন্ত্রী-সাংসদের আত্মীয়রা: পাবনার ঈশ্বরদীতে ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফের মেয়ের জামাই আবুল কালাম আজাদ মনোনয়ন পেয়েছেন। গত নির্বাচনে তিনি বিএনপির প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। এই পৌরসভায় তৃণমূল থেকে আজাদের নামই প্রস্তাব করে। অন্য প্রার্থীরা সেখানে দাঁড়ানোরই সাহস পাননি।
নোয়াখালীর বসুরহাটে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ভাই আবদুল কাদের মির্জা মনোনয়ন পেয়েছেন। অবশ্য তিনি বর্তমান মেয়রও।
পাবনার ভাঙ্গুড়া-ফরিদপুর আসনের সাংসদ মকবুল হোসেনের ছেলে গোলাম হাসনাইন মনোনয়ন পেয়েছেন। তিনি পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও। তবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান মেয়র আবদুর রহমান প্রধানও প্রার্থী ছিলেন। তৃণমূল থেকে দুজনের নাম পাঠালেও কেন্দ্রীয় বোর্ড সাংসদের ছেলেকে মনোনয়ন করে।
কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে স্থানীয় সাংসদ আফজাল হোসেনের ভাই আনোয়ার হোসেন আশরাফ মনোনয়ন পেয়েছেন। তৃণমূল থেকে চারজনের নাম পাঠানো হয়েছিল। আশরাফ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নতুন।
আরও বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-সাংসদের আত্মীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। আবার মনোনয়নের দৌড়ে থাকা কয়েকজন বাদও পড়েছেন।
আরও পড়ুন: 

মেয়র পদে মনোনয়ন পেলেন ২৩৫ জন