সংরক্ষণ হলো না পাহাড়তলী বধ্যভূমি

পাহাড়তলী বধ্যভূমি সংরক্ষণ করতে উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ রায় দিয়েছেন ২০১৪ সালের ১৭ মার্চ। কিন্তু এখনো রায় কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং বধ্যভূমির সম্মুখভাগে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভটি পড়ে আছে অবহেলায়। পাদদেশ ভরে গেছে ঝোপঝাড় আর আগাছায়। ছবিটি গত মঙ্গলবার বেলা একটায় তোলা l জুয়েল শীল
পাহাড়তলী বধ্যভূমি সংরক্ষণ করতে উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ রায় দিয়েছেন ২০১৪ সালের ১৭ মার্চ। কিন্তু এখনো রায় কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং বধ্যভূমির সম্মুখভাগে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভটি পড়ে আছে অবহেলায়। পাদদেশ ভরে গেছে ঝোপঝাড় আর আগাছায়। ছবিটি গত মঙ্গলবার বেলা একটায় তোলা l জুয়েল শীল

হেমন্তের দুপুর। রোদের তেজ নেই। মিষ্টি রোদ পড়েছে পাহাড়তলী বধ্যভূমির কালো স্তম্ভের গায়ে। লোহার ঘেরাও দেওয়া স্মৃতিস্তম্ভের পাদদেশ ভরা ঝোপঝাড়ে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে শুকনো পাতা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে দীর্ঘদিন হাত পড়েনি কারও। অবহেলা সয়ে দাঁড়িয়ে আছে একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতার এই সাক্ষী। গত মঙ্গলবার গেলে চোখে পড়ে এই চিত্র।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গাজী সালেহউদ্দিন আহমেদ রচিত প্রামাণ্য দলিল: মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বইয়ে উল্লেখ করেন, পাঁচ হাজারের বেশি লোককে পাহাড়তলী বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। ওই সময় এই স্থানটির পরিচিতি ছিল জল্লাদখানা নামে।
অথচ উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগের রায়ের দেড় বছর পার হলেও এখনো পাহাড়তলী বধ্যভূমি সংরক্ষণের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
বিশিষ্ট আট নাগরিকের করা রিট আবেদনের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ ২০১৪ সালের ১৭ মার্চ বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের আদেশ দেন। প্রজন্ম-৭১ নামের একটি সংগঠন ও একাত্তরের শহীদ পরিবারগুলো বারবার আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন করার জন্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি চালাচালি করে আসছে।
জানতে চাইলে প্রজন্ম-৭১-এর সভাপতি গাজী সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আদালতের রায়ের দেড় বছর পার হলেও কার্যকরে এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। আমি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি। বিভিন্ন দপ্তরে চিঠিও দিয়েছি। কিন্তু কাজ হচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘পাহাড়তলী বধ্যভূমিটি চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় জল্লাদখানা। এখানে হাজারো নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছিল একাত্তরের ১০ নভেম্বর। বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের জন্য ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বরাদ্দও দেওয়া হয়। কিন্তু আমি এখন হতাশ।’
একাত্তরের ১০ নভেম্বর গাজী সালেহউদ্দিন আহমেদের বাবা রেলওয়ের কর্মকর্তা আলী করিমসহ একই পরিবারের চারজনকে এখানে এনে হত্যা করা হয়েছিল। শুধু তাঁরা নন, ওই দিন হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া যুদ্ধকালে বিভিন্ন সময় পাঁচ হাজার নিরীহ বাঙালিকে ধরে এনে এখানে জবাই করা হয়েছিল বলে মামলার শুনানিকালে বিভিন্ন সাক্ষীর বক্তব্যে উঠে আসে।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু শহীদ পরিবারের সদস্যদের মতে, যে স্থানে স্মৃতিস্তম্ভটি করা হয়েছে সেটি ছিল পানির ছড়া। তাই তাঁরা যেখানে মানুষকে হত্যা করে হাড়গোড় ফেলে রাখা হয়েছিল, সেখানে স্মৃতিস্তম্ভের পাশাপাশি এটি সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন।
শহীদ পরিবারের সদস্যদের দাবি, যেখানে মূল বধ্যভূমি সেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউএসটিসি) অর্ধনির্মিত ভবনটি রয়েছে। আদালতের আদেশে এই ভবনটি উচ্ছেদ করে বধ্যভূমি সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছে।
প্রজন্ম-৭১ সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর পৌনে দুই একর ভূমিতে অবস্থিত বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের জন্য প্রজন্ম ৭১ দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিল। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৌনে দুই একর জমি অধিগ্রহণ করে বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের নির্দেশ দেন। এ জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ৯৪ লাখ টাকা। পরে জোট সরকার এসে ওই প্রকল্প বাতিল করে টাকা ফিরিয়ে নেয়। একই সময়ে সেই জমিটি কিনে নিয়ে ইউএসটিসি কর্তৃপক্ষ সেখানে ভবন নির্মাণ শুরু করেছিল।
কিন্তু সরকারের ওই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে মুহম্মদ জাফর ইকবাল, মুনতাসীর মামুন, মিলি রহমান, গাজী সালেহউদ্দিন আহমেদসহ আট বিশিষ্ট নাগরিক হাইকোর্টে রিট করেন। ২০১১ সালের ১৬ জানুয়ারি হাইকোর্ট রিট নিষ্পত্তি করে দিলে আবেদনকারীরা আপিল বিভাগে যান। আপিল বিভাগ ওই জমিতে বধ্যভূমি রয়েছে কিনা তা জানতে একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছিলেন। সেক্টর কমান্ডার কে এম সফিউল্লাহর নেতৃত্বাধীন ওই কমিটি প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদন দিয়েছিল। ওই প্রতিবেদন এবং সাক্ষীদের সাক্ষ্য বিবেচনা করে ওই বধ্যভূমি সংরক্ষণের নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ।
এ ব্যাপারে জানাতে চাইলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন বলেন, আপিল বিভাগ জমি অধিগ্রহণ করে বধ্যভূমিটি সংরক্ষণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তবে হাইকোর্টে এ–সংক্রান্ত আরেকটি মামলা রয়েছে। ওই আদেশ হাতে এলেই অধিগ্রহণ করে কাজ শুরু করা হবে।
আরেকটি মামলা প্রসঙ্গে গাজী সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘একটি মামলা হাইকোর্টে রয়েছে, সেটি তখনকার ডিসির বিরুদ্ধে। তখন ওই ডিসি আমাদের বধ্যভূমিতে কাজ করতে দিচ্ছিলেন না। যেহেতু আপিল বিভাগ বধ্যভূমি হিসেবে চিহ্নিত করে জমির ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন, সেখানে ওই মামলার আদেশের অপেক্ষার দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।’