'অসহায়' আ.লীগ প্রার্থীর শেষ ভরসা ভোটাররা

তিনবারের পৌর মেয়র তিনি। ২৭ বছর ধরে জনপ্রতিনিধি। এবারের পৌর নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন। কিন্তু প্রভাবশালী এক বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে তিনি এতটাই কোণঠাসা যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
ঘটনাস্থল শরীয়তপুরের নড়িয়া। এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান মেয়র হায়দার আলী স্থানীয় সাংসদ ও সাবেক ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। আর বিদ্রোহী প্রার্থী বর্তমান কাউন্সিলর ও পৌর আওয়ামী লীগের সদস্য শহিদুল ইসলামকে সমর্থন দিচ্ছেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম ইসমাইল হক।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী হায়দার আলীর অভিযোগ, বিদ্রোহী প্রার্থীর কারণে তিনি ঠিকমতো নির্বাচনী প্রচারই চালাতে পারেননি। তাঁর বাড়িতে হামলা হয়েছে। কর্মী-সমর্থকদের পেটানো হয়েছে। আওয়ামী লীগের ৮৫ জন কর্মী-সমর্থককে তিনটা মামলায় আসামি করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে তাঁর পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। শেষ মুহূর্তে এসে তাঁর এজেন্টদের মারধর ও ভয় দেখানো হচ্ছে। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তিনি এখন তাকিয়ে আছেন ভোটারদের দিকে। তাঁর আশা, জনগণ ভোট দিতে পারলে তিনিই নির্বাচিত হবেন। তবে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কি না, সেটাই তাঁর বড় শঙ্কা।
অবশ্য একই ধরনের আশঙ্কায় বিএনপির প্রার্থী রেজাউর রহমান ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মোসলেহ উদ্দিন ইতিমধ্যে নির্বাচন থেকে সরে গেছেন। তবে বিএনপির নেতা-কর্মীদের অনেকেরই দাবি, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর হুমকি ও মামলার ভয়েই তাঁরা সরে গেছেন।
এ বিষয়ে নড়িয়া পৌরসভার রিটার্নিং অফিসার ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা শেখ মো. জালাল উদ্দিন বলেন, ‘নড়িয়ার সহিংস পরিস্থিতিতে আমরাও উদ্বিগ্ন। অতিরিক্ত নিরাপত্তা চাওয়া হয়েছে। গতকাল পুলিশ পাহারায় সব জায়গায় সুষ্ঠুভাবে ব্যালট পৌঁছানো হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আজ শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হবে বলে আমরা আশাবাদী।’
গত সোমবার রাতে সদরঘাট থেকে শরীয়তপুরগামী লঞ্চে উঠে নড়িয়াগামী অনেক যাত্রীর সঙ্গে কথা হয়। পৌরসভার নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে ঘুরেফিরে সবাই বললেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থীই তো সেখানে আতঙ্কে আছেন। অন্যদের কী অবস্থা বুঝে দেখেন।
গতকাল মঙ্গলবার সারা দিন নড়িয়া ঘুরে এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে সেই চিত্রই আরও স্পষ্ট হলো। পৌরসভার রাস্তাঘাট ও বিভিন্ন কেন্দ্রের সামনে বিদ্রোহী প্রার্থী শহিদুল ইসলামের অনেক পোস্টার থাকলেও নৌকার পোস্টার খুঁজে পাওয়া কঠিন। বিভিন্ন কেন্দ্রের আশপাশে নারকেলগাছ প্রতীক বুকে লাগিয়ে যুবকেরা ঘুরছেন।
নৌকার লোকজন নেই কেন, জানতে চাইলে উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রার্থী হায়দার আলীর সমর্থকেরা জানালেন, অধিকাংশ জায়গায় নৌকার পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে এখন এজেন্টদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ সোমবার রাতেও ৮ নম্বর ওয়ার্ডে আবদুল জলিল সরদার নামে হায়দার আলীর এক সমর্থককে পেটানো হয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ছেলে কামরুল ইসলামকেও হুমকি দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় ভোটার ও আওয়ামী লীগের নেতারা জানান, গত এক সপ্তায় নড়িয়ায় একাধিক বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে। প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন করা হয়েছে। তবে পুলিশ কোনো ভূমিকা নেয়নি। এ ছাড়া গত কয়েক দিনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা, দলের প্রার্থীর বাসভবনে বোমা ও গুলি নিক্ষেপের ঘটনায় কাউকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
নড়িয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাসানুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই নির্বাচন সামনে রেখে গত এক মাসে আমাদের ৩০ জন কর্মীকে পেটানো হয়েছে। আমাদের উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির ছেলে সেকান্দারকে দুই দিন আগে কোপানো হয়েছে। সবাইকে মামলার ভয় দেখানো হচ্ছে। সর্বশেষ সোমবার রাতে উপজেলা চেয়ারম্যান ইসমাইল হক নিজে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে আমাদের এজেন্টদের হুমকি দিয়েছেন। আমরা সবাই আতঙ্কে আছি। তবে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে নৌকাই জিতবে।’
তবে বিদ্রোহী প্রার্থী শহিদুল ইসলাম এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, স্থানীয় সাংসদ শওকত আলী এই নির্বাচনে ত্রাস সৃষ্টি করেছেন। তাঁর আটজন কর্মীকে মারধর ও চারটি অফিস ভাঙচুর করা হয়েছে। সাংসদের কারণে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে তিনি সংশয়ে আছেন।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী হায়দার আলী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদ্রোহী প্রার্থী শেষ মুহূর্তে এসে প্রচারণা চালাচ্ছেন, আমি নির্বাচন থেকে সরে গেছি। কিন্তু আমি নির্বাচন থেকে সরিনি। আমি দুপুরে এলাকার লোকজনকে এই কথা জানাতে গেলে থানার ওসি আমাকে ফোন করে বলেন, আমি কেন প্রচার চালাতে গেছি। আবার উপজেলা চেয়ারম্যান ইসমাইল হক শটগান নিয়ে গতকাল তাঁর কার্যালয়ে গেছেন। তিনি সবাইকে ভয় দেখাচ্ছেন।’
এসব বিষয়ে জানতে ইসমাইল হকের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রথম আলোর পরিচয় শুনে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি। পরে মুঠোফোনে বার্তা দিলেও তিনি উত্তর দেননি। মুঠোফোনও আর ধরেননি।
উন্নয়নের ছোঁয়াহীন নড়িয়া পৌরসভার মোট ভোটার ১৫ হাজার ৮২৩ জন। এর মধ্যে ৭ হাজার ৯১৬ জন মহিলা ও ৭ হাজার ৯০৭ জন পুরুষ। নয়টি কেন্দ্রের মোট ৪২টি ভোটকক্ষে তাঁরা আজ ভোট দেবেন। তবে ভোটের পরিস্থিতি খারাপ হলে অনেকেই ভোট দিতে যাবেন না বলে জানালেন।
এদিকে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত জানা গেছে, গতকাল বিকেলে পৌর এলাকার বাহিরদীঘি এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী হায়দার আলীকে আটকে দেয় বিদ্রোহী প্রার্থীর লোকজন। পরে স্থানীয় জনতা তাঁকে উদ্ধার করে।