পদ্মা সেতু হচ্ছে, খরচও বাড়ছে

পদ্মা সেতু প্রকল্প
পদ্মা সেতু প্রকল্প

নিজস্ব অর্থেই পদ্মা নদীর ওপর সেতু হচ্ছে। সেতুর কাজ এগোচ্ছে, এর ব্যয়ও বাড়ছে। মূল পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ পুরোদমে শুরু হওয়ার আগেই দুই দফায় খরচ বাড়ল ২৮৩ শতাংশ।
গতকাল মঙ্গলবার দ্বিতীয়বারের মতো পদ্মা সেতুর ব্যয় আরও ৮ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। ফলে পদ্মা সেতুর ব্যয় এখন দাঁড়াল সব মিলিয়ে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকায়। এই অর্থ মূলত দেশের মানুষের দেওয়া করের টাকা।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) গতকাল বাড়তি ব্যয়সহ প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা শেরেবাংলা নগরের জিইসি সম্মেলনকক্ষে এ কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করেন।
প্রকল্পটির যাত্রা শুরু হয় ২০০৭ সালে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ওই বছরের ২৮ আগস্ট ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার প্রকল্প পাস করেছিল। পরে আওয়ামী লীগ সরকার এসে রেলপথ সংযুক্ত করে ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম দফায় সেতুর ব্যয় সংশোধন করে। তখন এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। আরও ৪০ শতাংশ খরচ বাড়িয়ে গতকাল আবার দ্বিতীয়বারের মতো সংশোধন করা হলো। তবে দ্বিতীয় দফায় সংশোধনের পর মূল সেতু নির্মাণের যে খরচ ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা, তা ঠিকই আছে। ব্যয় সংশোধন করা হলেও প্রকল্প সময় বাড়ানো হয়নি। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে এ প্রকল্প শেষ হবে।
ব্যয় বৃদ্ধি সম্পর্কে গতকাল পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেন, আগে অনুমানের ওপর নির্ভর করে প্রকল্পটির ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল। তখন বিস্তারিত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও প্রকৌশল প্রাক্কলন ছিল না। এর দুটি করা হয় ২০১৪ সালে। তাই এখন দুটির ভিত্তিতে নতুন করে বাস্তবসম্মত ব্যয় বেড়েছে।
তবে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করা হলেও এই ব্যয় বৃদ্ধির সমালোচনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ভবিষ্যতে ব্যয় আরও বাড়বে বলে তাঁরা মনে করেন। অর্থ ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা।
বঙ্গবন্ধু সেতুর (যমুনা সেতু) অর্থনৈতিক মূল্যায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা সাবেক সচিব এম ফাওজুল কবির খান ব্যয়ের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতুর (যমুনা সেতু) শুরু থেকে শেষ হওয়া পর্যন্ত কী পরিমাণ ব্যয় বেড়েছিল, সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেত। প্রকৃত দর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সেই সেতুর খরচ প্রাক্কলন করা হয়েছিল। এতে ব্যয় ৮ থেকে ৯ শতাংশের বেশি বাড়েনি। কিন্তু পদ্মা সেতুর মূল কাজ শুরুর আগে প্রায় তিন গুণ ব্যয় বাড়ল। এটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। যেকোনো নাগরিক এতে উদ্বেগ প্রকাশ করবে।
এম ফাওজুল কবির খানের মতে, নিজস্ব অর্থে এ সেতু হবে। তাই মূল সেতু শুরুর আগেই দুই দফা ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি সরকারি ব্যয়কাঠামোর জন্য ভালো নয়। রাজস্ব আদায়েও ঘাটতি রয়েছে। আর এ ধরনের বিষয় দেখভাল করার জন্য ভারতে মহানিরীক্ষক রয়েছেন। বাংলাদেশে থাকলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ প্রতিষ্ঠানের সেই সক্ষমতা নেই। আবার স্বাধীন অবস্থান নেওয়ার মতো পরিস্থিতিও নেই।
বাড়তি খরচ: গতকালের একনেক সূত্রে জানা গেছে, মূলত নদীশাসনের কাজেই ব্যয় বেড়েছে বেশি। ২০১১ সালের প্রাক্কলনে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৪ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা। ৫ হাজার কোটি টাকা বেড়ে এখন তা দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকায়। প্রাথমিকভাবে ৮ কিলোমিটার নদীশাসনের কথা থাকলেও এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩ কিলোমিটার। বাড়তি ১ দশমিক ৩ কিলোমিটারের জন্য ব্যয় বাড়ল ৫ হাজার কোটি টাকা। ২০০৭ সালের মূল প্রকল্পে নদীশাসনে বরাদ্দ ছিল মাত্র ২ হাজার ৬১২ কোটি টাকা।
জাজিরা ও মাওয়া অংশে সংযোগ সড়ক, সার্ভিস এরিয়া এবং আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণের খরচ এখন মূল প্রকল্পে ঢুকে গেছে। আগে ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) অর্থায়নে আলাদাভাবে এই অবকাঠামো তৈরির কথা ছিল। জাজিরা অংশে সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো তৈরি করতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৯৭ কোটি টাকা। অন্যদিকে মাওয়া অংশে সংযোগ সড়ক ও অন্য অবকাঠামো তৈরি করতে ১৯৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সার্ভিস এরিয়া নির্মাণে খরচ ২০৮ কোটি টাকা।
২০১১ সালের প্রাক্কলনের পুনর্বাসন বাবদ খরচ আরও ১০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা করা হয়েছে। ২০০৭ সালে এ খাতে খরচ ধরা হয়েছিল ৫২৮ কোটি টাকা।
জমি অধিগ্রহণেও খরচ বাড়ানো হয়েছে। ২০০৭ সালে যেখানে এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩০৬ কোটি টাকা, এখন সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। ২০১১ সালে এ খাতে ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৮৬ কোটি টাকা।
তবে পরামর্শক, কর্মীর বেতন, যানবাহন, শুল্ক-করসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক খাতে ব্যয় কমেছে। ২০০৭ সালে যেখানে এসব খাতে খরচ ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা, সাড়ে ৮ বছর পরে তা কমিয়ে ২ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া মালামাল পরিবহনের সুবিধার্থে বর্তমান সড়ক চওড়া করা, ফেরিঘাট স্থানান্তরসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে নতুন করে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪০৮ কোটি টাকা।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, সস্তা টাকায় এ সেতু করতে পারলে ভালো হতো। নিজস্ব অর্থায়নে এ সেতু করার কথা বলা হলেও আসলে সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে টাকা ধার করে খরচ মেটাবে। এ টাকাও পরিশোধ করতে হবে।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি সম্পর্কে আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান এ প্রকল্পে থাকলে অর্থ খরচের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষেরই জবাবদিহি থাকত। কিন্তু সরকার নিজেই এখন টাকা খরচ করবে। তাহলে জবাবদিহি কীভাবে হবে? দাতা সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) কাজ করা এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, দ্বিতীয় দফায় খরচ বৃদ্ধিই শেষ নয়, বরং শুরু। রেলপথের জন্য সামনে খরচ আরও বাড়বে।
উল্লেখ্য, পদ্মা সেতু প্রকল্পে সিংহভাগ অর্থ দেওয়ার কথা ছিল বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (আইডিবি)। দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে সরে পড়ে। একে একে সরে যায় এডিবি ও আইডিবি। এরপর সরকার নিজস্ব অর্থেই এ সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়।
২০১৫-১৬ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বইয়েও এ প্রকল্পে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে বরাদ্দের পরিমাণ উল্লেখ আছে। নতুন করে যে প্রকল্প সংশোধন করা হয়েছে, সেখানে পুরো অর্থই নিজস্ব তহবিল থেকে দেওয়া হবে।