সৌদি ও জর্ডানে গিয়ে জুটল শুধুই নির্যাতন

‘কমপক্ষে ১০ বার আমাকে বেচাকেনা ও হাতবদল করা হয়েছে। ঢাকা থেকে রিয়াদে পৌঁছানোর পর গভীর রাতে পথ বদল, মানুষ বদল, গাড়ি বদল করে ছয় দিনে আমাকে মরুভূমির মতো একটি এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। ২০ কক্ষের ওই বিশাল বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর প্রথম কদিন আমাকে তেমন কাজ করতে হয়নি, সকাল হলেই একজন আরব নারী ঘরে তালাবদ্ধ রেখে বাইরে চলে যেতেন। সপ্তাহ না ঘুরতেই শুরু হয় আমার ওপর যৌন নির্যাতন, তখন বুঝতে পারি আমাকে অবৈধ কাজের জন্য নিয়ে আসা হয়েছে।’ কাঁদতে কাঁদতে এভাবেই নিজের মানসিক, শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের কথা প্রথম আলোর কাছে বলছিলেন সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা এক নির্যাতিত নারী।
ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ঝিনাইদহসহ বিভিন্ন জেলার বেশ কয়েকজন নারী এ ধরনের নির্যাতন ও প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে তাঁরা জানিয়েছেন, সৌদি আরব ও জর্ডানের বিভিন্ন শহরে তাঁদের মতো অনেক বাংলাদেশি নারীকে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক চক্রের হাতে পাচার হওয়া এ রকম একজন বাংলাদেশি নারীর দাম প্রায় পাঁচ লাখ টাকা।
এই নারীদের বেশির ভাগ দালালের মাধ্যমে রাজধানীর ফকিরাপুলের জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এমএইচ ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক মকবুল হোসেনকে টাকা দিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। র্যাব-৩-এর অধিনায়ক খন্দকার গোলাম সারোয়ার বলেন, পাচারের সঙ্গে জড়িত ওই এজেন্সির মালিকসহ মোট ১১ জন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। তাঁদের পল্টন থানায় হস্তান্তর করা হয়।
পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) তোফায়েল আহমেদ জানান, তাঁরা দুদিনের রিমান্ডে ছিলেন। গত সোমবার তাঁদের জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। তবে গতকাল রাতে মকবুলের ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে দুটো মুঠোফোনই সচল পাওয়া গেছে।
যেভাবে প্রতারণা করা হচ্ছে: ঢাকার মাদারটেকের একজন ভুক্তভোগী নারী প্রথম আলোকে বলেন, তিনি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। তাঁর মহল্লার ‘ইকবাল’ নামে একজন দালাল তাঁকে বিদেশে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। বলেন, হাসপাতালের আয়ার ভিসা আছে। বেতন মাসে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। গেলে দেড় লাখ টাকা লাগবে। সব শুনে রাজি হন।
এরপর ওই নারীকে প্রথমে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি করিয়ে কিছু আরবি শব্দ শিখিয়ে সনদ দেওয়া হয়। ওই সনদ ও পাসপোর্ট দিয়ে ভিসা করানো হয়। এরপর তাঁকে তিন দফায় বিমানবন্দরে নেওয়া হয়। ওই নারী জানান, গত ২৩ আগস্ট তাঁদের ফ্লাইট ছাড়ে। ওই বিমানে তাঁর মতো আরও অনেক নারী ছিলেন। রিয়াদে পৌঁছালে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় গারদঘরে। সেখানে অনেক বাংলাদেশি নারী ছিলেন। একজন লোক এসে তাঁকে নিয়ে আরব এক নারীর কাছে যায়। ওই নারী তাঁকে একটি বাড়িতে তিন দিন আটকে রাখেন। এরপর তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আরেক নারীর কাছে। এক দিন পর নেওয়া হয় একটি বাড়িতে। সেখানে শুরু হয় নির্যাতন। কেড়ে নেওয়া হয় তাঁর মুঠোফোন।
ভুক্তভোগীর স্বামী প্রথম আলোকে বলেন, এমএইচ ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি রিক্রুটিং এজেন্সি তাঁর স্ত্রীকে বিদেশ পাঠায়। তিনি সেখানে গিয়ে সব জানান। এজেন্সির মালিক জানান, কোনোভাবেই তিন মাসের আগে ফেরত আনা সম্ভব না। বেশ কয়েক দিন পর জানান, দেড় লাখ টাকা দিলে তাঁরা চেষ্টা করবেন। পরে অর্ধেক টাকা দিলে তাঁর স্ত্রীকে অসুস্থ অবস্থায় ঢাকায় ফেরত পাঠানো হয়।
জানতে চাইলে সৌদিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন অভিযোগ আমাদের কাছে এখনো আসেনি। সৌদিতে ওই মেয়েদের কোন এজেন্সি গ্রহণ করেছে ও স্মার্ট কার্ডে কাদের নাম আছে, সেটা জানতে পারলে এখানকার এজেন্সির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেবে এ দেশের সরকার।’
সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত প্রথম আলোকে জানান, দুই দেশের মধ্যে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সম্পাদিত চুক্তির অংশ হিসেবে বাংলাদেশি পুরুষ গৃহকর্মী নিয়োগে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করেছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি নারী গৃহকর্মীদের নিকটাত্মীয়রাও সেখানে কাজের সুযোগ পাবেন।
গাজীপুরের ভুক্তভোগী এক নারী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁকেও হাসপাতালে কাজ করার কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয় জর্ডানে। সেখানে শহর থেকে অনেক দূরে একটি বাড়িতে নিয়ে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। এতে তাঁর একটি চোখ নষ্ট হওয়ার পথে। পরে তাঁর স্বামী সাড়ে তিন লাখ টাকা দিয়ে দুই মাস পর তাঁকে দেশে ফেরত আনেন।
মানিকগঞ্জের আরেক ভুক্তভোগীর পরিবার বলে, গত ২১ জুলাই হাসপাতালে চাকরির জন্য তাঁদের মেয়েকে দেড় লাখ টাকা দিয়ে জর্ডান পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর পরই মেয়ে জানায়, তাকে অশ্লীল কাজের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। এরপর তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। কাঁদতে কাঁদতে ওই নারী বলেন, ‘আমার মেয়ে ছয় মাস হয়েছে বিদেশে গেছে, এখনো কোনো খবর পাইনি। আছে না মরে গেছে তা-ও জানি না। প্রতিদিন রিক্রুটিং এজেন্সি কার্যালয়ে যাইতেছি, কিছুই বলে না’।
জর্ডানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এনায়েত হোসেন বলেন, এখানে যে মেয়েরা পোশাক কারখানায় কাজ করেন, তাঁদের তেমন অভিযোগ নেই। কিন্তু বাসায় যাঁরা কাজ করতে আসেন, তাঁরা বিভিন্ন সময় অভিযোগ করেন। তিনি দাবি করেন, যৌন নির্যাতনের ঘটনা ওখানে কম, মারধরের অভিযোগ বেশি। এ ছাড়া বেশ কিছু আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।
গত ৮ নভেম্বর সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম দাবি করেন, সৌদি আরবে নারী কর্মীদের ওপর যৌন নির্যাতনের খবর সত্য নয়। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।