আমাদের পাগলামিতে আপনাকে স্বাগত

আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের সবচেয়ে পুরোনো স্বেচ্ছাসেবক আয়ুব সরকার। এবারের ঢাকা আঞ্চলিক গণিত অলিম্পিয়াডে কতজনের নিবন্ধন হয়েছে তা জানাতে এসেছিল সে । সংখ্যাটা শুনে চমকে গিয়ে আবার জানতে চাই, ‘৩৫০০?’

উত্তর আসে, ‘জি। নিবন্ধনের আর কোনো বই নাই। সার্টিফিকেটও নাই।’

কথা শুনে আমার মন ফিরে গেছে ২০০২ সালের ২৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায়। পরের দিন বাংলাদেশের প্রথম মিনি গণিত অলিম্পিয়াড হবে কারওয়ান বাজারের সিএ ভবনের দশম তলার মিলনায়তনে। আমার আর ফারহানা আলমের চিন্তা হলো, সেখানে ১০০ জন অংশগ্রহণকারী পাব তো?
দুই দিন ধরে আমি বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক ও অভিভাবকদের কাছে যাচ্ছি। বলছি, ‘আপনার সন্তানকে কয়েক ঘণ্টার জন্য আমাদের কাছে দিন। বিকেলে আবার পৌঁছে দিয়ে যাব।’

মাত্র ১৫ বছর আগে এভাবে আমরা প্রথম মিনি গণিত অলিম্পিয়াড শুরু করি। আর এখন? ওই যে সাড়ে তিন হাজার জন, তা কেবল ঢাকা উৎসবেই। ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে আজ শুক্রবার সকাল থেকে শুরু হয়েছে এই উৎসব। কলেজের প্রায় সব শ্রেণিকক্ষেই মূল পর্ব তথা অলিম্পিয়াড হবে। অন্যান্য পর্ব তো থাকবেই।

গণিত অলিম্পিয়াডের শুরুতে অনেকেই মনে করতেন এ রকম একটি কঠিন বিষয় নিয়ে আর যা-ই হোক উৎসব বা আনন্দমুখর পরিবেশ তৈরি করা যাবে না। অনেকেই আমাদের কর্মকাণ্ডকে পাগলামি বলতেন। সিএ ভবনের মিলনায়তনে যেসব শিক্ষার্থীকে ডেকে এনেছিলাম, তাদেরই একজনের মা প্রথম বলেছিলেন, ‘পাগলামি আর কী!’ এর পর থেকে এই পাগলামির কথা আমি শুনেই যাচ্ছি।

গণিত অলিম্পিয়াড শুরু হওয়ার পর হন্তদন্ত হয়ে আমাকে পাগল বলেছিলেন প্রয়াত গৌরাঙ্গ স্যার। যেদিন উনি প্রথম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের (আইএমও) প্রশ্ন দেখেন, সেদিন রাতেই ফোন দিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনি তো পাগল, মুনির সাহেব। এই অঙ্ক তো আমাদের সিনিয়র স্টুডেন্টরাই পারবে না। আপনি ভাবছেন এগুলো এসএসসি-এইচএসসির ছাত্রছাত্রীরা করে ফেলবে। আপনি কী পাগল?’

উত্তরে আমি বলেছিলাম, স্যার, আমাদের ছেলেমেয়েদের দেখিয়ে দিলে ওরা পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিতে পারবে। সে-ও এক দশকের বেশি হয়ে গেল। গত কয়েক বছরে আমাদের এই পাগলামিটা স্বতঃসিদ্ধ হিসেবেই মেনে নিয়েছে পরিচিতজনেরা। তাই আর প্রশ্ন করে না।

গত ১৫ বছরে আমরা তিল তিল করে একটা প্রবলেম সলভিং কালচার তৈরির চেষ্টা করছি। শুরু করেছি গণিত দিয়েই। কারণ সেটাই বিজ্ঞানের প্রাণভোমরা। সেটি করতে গিয়ে আমরা এক আশ্চর্য জগতের সন্ধান পেয়ে গেছি। জাফর ইকবাল স্যারের ভাষায় এটা হলো, ‘দুই ইঞ্চি থিওরি।’

ড. মাহবুব মজুমদারের ভাষায়, ‘ওরা এক একটা জিনিয়াস। এটা হলো, যারা একটু বেশি জানে, তাদের দিয়ে যারা একটু কম জানে তাদের শেখানো, দল বেঁধে পড়ার অভ্যাস তৈরি করা এবং বিষয়কে প্রবলেম সলভিংয়ে টেনে নামানো।’ সেই কাজটা করে ফেলাতে আর একটা মজার ঘটনাও ঘটে গেল। তা হলো, আমাদের শিক্ষার্থীরাই গণিতের কঠিন সব বিষয়ে বই লিখতে শুরু করে দিল। এমনকি তাদের কেউ কেউ এইচএসসি পার হওয়ার আগেই বই লিখে ফেলল। সে বইও আবার নম্বর থিউরি বা কম্বিনেটরিক্সের ওপর। এ বিষয়ে বাংলাতে মাত্র দু-একটা বই আছে!

বছর কয়েক আগে আমরা বইমেলায় গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির মাধ্যমে কেবল গণিতের বইয়ের একটা স্টল করেছি। দেখা গেল, আমরা প্রায় শতাধিক গণিতের বই সেখানে রাখতে পেরেছি। আমি বুঝলাম, আমরা একটা পাগলের খনি পেয়ে গেছি। এটি একটি সংক্রামক ব্যাধি।

সময় প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফরিদ আহমেদ আমাকে ধরেবেঁধে একটা বই লিখিয়ে নিলেন। বইয়ের নাম ছিল ‘আমাদের গণিত উৎসব’। সে সময় পরিচয় হলো ফরিদ ভাইয়ের ভাগনে রনির সঙ্গে। রনি পরে নিজেই তার একটা প্রকাশনী খুলে বসে। নাম তাম্রলিপি প্রকাশনী। একদিন এসে আমাকে বলল, ‘স্যার, আমি প্রতিবছর বিজ্ঞান আর গণিতের বই বের করতে চাই।’ আমি ভাবলাম, পাগল বলে কী! পরীক্ষা নেওয়া যাক।

আমার হাতের কাছে ছিল যাদব চক্রবর্তীর পাটিগণিত। ঢাউস, মোটা একটা গণিতের বই। বললাম, এটা যদি বের করতে পারো, তাহলে তোমার বিষয় আমরা বিবেচনা করব। এ ঢাউস বইটি নিশ্চয়ই শ খানেক কপিও বিক্রি হবে না। কাজে রনি সেটা প্রকাশও করবে না। আমাকেও আর জ্বালাবে না। কিন্তু আমি তখনো পাগল চিনতে শিখিনি। কয়েক দিন পরে এসে জানাল বইয়ের কাজ শেষ। আমি একটা ভূমিকা লিখে দিলে বইটা প্রকাশ হবে। দাম মাত্র ৭০০ টাকা। দামটা তো মুখ্য না। মুখ্য হলো আমি আটকা পড়েছি আমার কথায়।

তারপর থেকে রনি একাই মনে হয় বাংলা ভাষায় গণিতের সবচেয়ে বেশি বই প্রকাশ করে ফেলল। এ বছরও বেশ কয়েকটি গণিতের বই বের হয়ে গেছে তার প্রকাশনী থেকে। এর মধ্যে একটা লিখেছে আমাদের এইচএসসি উত্তীর্ণ আইএমও প্রতিযোগী মুতাসিম মিম! আমার হিসাবে গত ১০ বছরে বাংলা ভাষায় গণিতের যত বই প্রকাশিত হয়েছে, তার আগের ৯০ বছরে তার সিকি ভাগও প্রকাশ হয়নি!

গণিত অলিম্পিয়াডে আমাদের বড় একটা অর্জন হলো ড. মাহবুব মজুমদারকে কোচ হিসেবে পাওয়া। স্ট্যানফোর্ড, এমআইটি আর কেমব্রিজের এই অ্যালামনাই ইমপেরিয়াল কলেজের চাকরি ছেড়ে এখন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের বিনা বেতনের কোচ। তো, মাহবুব মজুমদার আমার কাছে একদিন জানতে চাইলেন—আমাদের মেধাবীরা কেন এমআইটি-হার্ভার্ডে পড়তে যায় না। আমি জানালাম—যায় তো। মাস্টার্স, পিএইচডি করতে যায়। মাহবুব বললেন, তা কেন হবে? ওরা তো ইচ্ছে করলে আন্ডারগ্রেডেও যেতে পারে। আমি বললাম, ‘আপনি পাগল নাকি?’
তো, দেখা গেল এখানেও অনেক পাগল এসে জুটে গেল। প্রথম সৌমেন আর তানভীর, তারপর নাজিয়া আর নায়েল। আর এখন তো আমাদের কেও না কেও যাচ্ছে প্রতিবছর এমআইটি, হার্ভার্ড, ওয়াটারলুতে!

আইওমওতে আমরা আস্তে আস্তে ওপরে উঠতেও শুরু করেছি। বাংলা-আইটি নামে একটি ইয়াহু গ্রুপে ২০০৫ সালে আমার গুষ্টি উদ্ধার করা হয়েছিল যে কেন আমি আইওমওতে দল পাঠানোর মতো ধৃষ্টতা দেখিয়েছি। আমি কিছু বলিনি। কারণ আমি জানতাম, আমাদের খুদে পাগলরা এসব ছেঁদো প্রশ্নের জুতসই উত্তর দিয়ে দেবে। দিয়েছেও তারা। ২০১৫ সালে আমাদের পাগলেরা দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে ফেলেছে। ১০৪টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ৩৩তম। ভারত ৩৭, শ্রীলঙ্কা ৫১, পাকিস্তান ৮৫!

শুধু যে নতুন প্রজন্মের পাগল জুটেছে তা না। আমরা দেখলাম (<http://munirhasan. com/mzi/>) কায়কোবাদ স্যাররা এক শহর থেকে অন্য শহরে ছুটে যাচ্ছেন। অধ্যাপক খোদাদাদ খান আর অধ্যাপক লুৎফুজ্জামান স্যারের মতো প্রায় আশি-ঊর্ধ্ব দুই তরুণ মাইক্রোবাসে করে যাচ্ছেন সারা দেশের আনাচকানাচে। যে বিষয়টাকে সবাই অঙ্ক বলত, সেটা ঠিকঠাকভাবে গণিত হয়ে গেল।

আমাদের সেই পাগলামির পরিসর অনেক বেড়েছে। ১০০ জনের যে অলিম্পিয়াড করতে আমার নাভিশ্বাস উঠেছিল, এখন প্রতিবছর সরাসরি ৩০ হাজার আর তৃণমূলের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী এর সঙ্গে যুক্ত হয়। সরকারি দলিল-দস্তাবেজে গণিত অলিম্পিয়াডকে স্বীকৃতি দিয়েছে অনন্যসাধারণ উদ্যোগ হিসেবে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক বিশ্বের দশটি সামাজিক উদ্যোগের তালিকায় যুক্ত করেছে এই অলিম্পিয়াডের নাম। আর এসবই সম্ভব হয়েছে একদল স্বেচ্ছাব্রতীর কারণে। যারা নিজেদের বলে গণিত অলিম্পিয়াড স্বেচ্ছাসেবক বা মুভার্স। সঙ্গে আছে প্রথম আলো বন্ধুসভা।

আর আলাদা করে বলতে হয় ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের কথা। ২০০৪ সালে গণিত অলিম্পিয়াডের পরিসর বাড়ানোর জন্য আমরা যখন পৃষ্ঠপোষক খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম, তখন থেকেই ডাচ-বাংলা ব্যাংক আমাদের স্বপ্নের সারথি। প্রথম আলো সম্পাদকের ঐকান্তিক চেষ্টায় ডাচ-বাংলা ব্যাংক যুক্ত হয়ে যায় আমাদের সঙ্গে। আমাদের ব্যাংক ডাচ-বাংলা ব্যাংককে জানাই কৃতজ্ঞতা।

আজ আমাদের এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় আয়োজন। পরীক্ষা পর্ব ছাড়া বাকি সবই সবার জন্য উন্মুক্ত। আমাদের এই গণিত মেলায় সবার নিমন্ত্রণ।