বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের করুণ মৃত্যু

হাফিজুর মোল্লা
হাফিজুর মোল্লা

এক মাস আগে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাবা অটোরিকশাচালক। বাসা ভাড়া করে থাকার সামর্থ্য ছিল না। তাই ছাত্রলীগের ‘বড় ভাইদের’ মাধ্যমে উঠেছিলেন সলিমুল্লাহ মুসলিম (এস এম) হলে। থাকতে হতো বারান্দায়, যেতে হতো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে।
মার্কেটিং বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী হাফিজুর মোল্লা (১৯) শীতের রাতের এত ধকল সইতে পারেননি। আক্রান্ত হন নিউমোনিয়া ও টাইফয়েডে। চলে যান গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার সদরপুর ইউনিয়নের পূর্ব শ্যামপুরে। শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ হলে ভালো চিকিৎসার জন্য রওনা দেন ঢাকায়। গত মঙ্গলবার রাতে পথেই তিনি মারা যান।
হাফিজুর বিশ্ব জাকের মঞ্জিল উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০১৩ সালে জিপিএ-৫ পেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। গত বছর সদরপুর কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। গত মাসের প্রথম দিকে তিনি হলে ওঠেন। থাকতেন দোতলার দক্ষিণ পাশের বারান্দায়।
হাফিজুরের সহপাঠী ও পরিবারের অভিযোগ, শীতের মধ্যে বারান্দায় থাকা এবং রাতের বেলায় ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে যাওয়ার কারণে হাফিজ ঠান্ডায় আক্রান্ত হন। অসুস্থ অবস্থায় তীব্র শীতের মধ্যেও হাফিজকে গত ২৬ জানুয়ারি রাতে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা বাইরে থাকতে হয়। তাঁকে প্রায়ই অন্য কর্মীদের সঙ্গে হলের মাঠে ‘গেস্টরুম’ করতে হতো। তবে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, হাফিজ আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন।
গেস্টরুম হচ্ছে ছাত্রলীগের একটি দলীয় রীতি। একটি নির্দিষ্ট সময়ে ছাত্রলীগের কনিষ্ঠ কর্মীদের সঙ্গে জ্যেষ্ঠরা বসে আলাপ-আলোচনা করেন। এ সময় তাঁদের ছাত্রলীগ করতে বা হলে থাকতে হলে কী করতে হবে, সে সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া হয়। মূলত এটি ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার একটি প্রয়াস। বিভিন্ন সময় সাধারণ ছাত্রদের এ কর্মসূচিতে যোগ দিতে চাপ দেওয়ারও অভিযোগ আছে।
হাফিজুরের বাবা ইসহাক মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত সপ্তাহের বুধবার হাফিজ ঢাকা থেকে বাড়ি এসেছিল। প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে এসেছিল। কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, “আমি আর বাঁচব না।” জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী হয়েছে। ও জানায়, শীতের মধ্যে বাইরে ‘‘ডিউটি’’ করতে হয়। ওই দিন নাকি সে ওদের বলেছে, তার শরীরটা ভালো না। ডিউটিতে যেতে পারবে না। কিন্তু তারপরও মাঠে নিয়ে গিয়ে রাত সাড়ে নয়টা থেকে একটা পর্যন্ত দাঁড় করিয়ে রেখেছে।’
হাফিজুর হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক দিদার মুহাম্মদ নিজামুল ইসলামের পক্ষের কর্মী ছিলেন। দিদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে সপ্তাহে দুই দিন গেস্টরুম করি। কিন্তু প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের গেস্টরুম করানো একেবারেই নিষেধ। তারা সিনিয়রদের সর্বোচ্চ সালাম দিয়ে চলে যায়।’ পরে তিনি খোঁজ নিয়ে জানান, গত ২৬ জানুয়ারি (মঙ্গলবার) রাতে কিছুক্ষণের জন্য প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জ্যেষ্ঠরা মাঠে কথা বলেছিলেন। তবে জোর করে হাফিজুরকে কর্মসূচিতে নেওয়ার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমি নিজে ওকে হলে তুলেছি। বলেছি কোনো ধরনের সমস্যা হলে আমাকে বলতে। কিন্তু সে এ নিয়ে আমাকে কখনোই কিছু বলেনি।’
হাফিজুরের বাবা আরও বলেন, ‘হাফিজ ঢাকায় চিকিৎসক দেখিয়েছিল। তাকে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছিলেন চিকিৎসক। কিন্তু বাড়িতে আসার পর আবার চিকিৎসক দেখালে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিউমোনিয়া ও টাইফয়েড ধরা পড়ে। স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করার পর অবস্থার অবনতি দেখে তাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য রওনা হই। পথে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে রাত ১১টা ২০ মিনিটে মারা যায় ছেলেটা।’
ফরিদপুরে হাফিজুরের চিকিৎসক আবু আহমেদ আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, হাফিজের নিউমোনিয়া ও টাইফয়েড হয়েছিল। ঠান্ডার কারণে বা ইনফেকশন থেকে এ রোগ হয়।
মুঠোফোনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ইসহাক মোল্লা বলতে থাকেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। আমার সম্পদ ছিল একটাই। সেই পোলাডাই কষ্ট পাইয়া মইরা গেল।’
হাফিজুরের চাচা আবদুল জব্বার বলেন, গত বুধবার হাফিজের লাশ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। কিস্তিতে একটি অটোরিকশা কিনে জীবিকা নির্বাহ করেন তাঁর বাবা ইসহাক মোল্লা। সেই কিস্তির টাকা আজও শোধ করতে পারেননি। পূর্ব শ্যামপুর গ্রামে আড়াই শতক জমির ওপর তাঁদের একটি টিনের ঘর রয়েছে। একটিই ছেলে ছিল। হাফিজুর বাবাকে বলতেন, ‘আর কয়েকটা বছর কষ্ট করো, বাবা। পড়াশোনা করে আমি একটা চাকরি তো পাব। আমাদের আর কষ্ট থাকবে না।’
জানতে চাইলে এস এম হলের প্রাধ্যক্ষ গোলাম মোহাম্মদ ভূঁইয়া বলেন, ছাত্রলীগের গেস্টরুমের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। হাফিজুরের বারান্দায় থাকার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘নিউমোনিয়া বারান্দায় থাকলেও হতে পারে, রুমে থাকলেও হতে পারে। আর বারান্দায় তো অনেকেই থাকে। তাদের তো কিছু হয়নি। হতে পারে সে অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি চলে গেছে এবং সেখানে মারা গেছে।’

অারও পড়ুন : হাফিজুরের বাড়িতে চার দিনেও চুলা জ্বলেনি
হাফিজুর, আমাদের ক্ষমা করো