১০১ হত্যার পেছনে মুফতি হান্নান

হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (হুজি-বি) জঙ্গিরা দেশে সাত বছরে অন্তত ১৩টি নাশকতামূলক ঘটনা ঘটায়। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১০১ জন। আহত হয়েছেন ৬০৯ জন। এসব হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন হুজি-বি ও হরকাতুল মুজাহিদীনের অন্যতম শীর্ষ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান। এর মধ্যে একটি হামলা ও দুটি হামলাচেষ্টার ঘটনার মূল লক্ষ্যবস্তু ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এসব বোমা ও গ্রেনেড হামলার ঘটনায় মুফতি হান্নানের বিরুদ্ধে ১৭টি মামলা হয়েছে। দুটির বিচার শেষ হয়েছে। এর মধ্যে সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার দায়ে মুফতি হান্নানসহ তিন জঙ্গির ফাঁসি ও দুজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। এ মামলায় আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদন করে গতকাল বৃহস্পতিবার হাইকোর্ট আদেশ দেন।
এ ছাড়া ২০০১ সালে রমনায় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা মামলায় হান্নানসহ হুজির আট জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এ মামলার ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদন) হাইকোর্টে শুনানির অপেক্ষায় আছে। হান্নানের বিরুদ্ধে থাকা আরও ১৩টি মামলার বিচার চলছে। দুটির অধিকতর তদন্ত চলছে।
মুফতি হান্নান ২০০৬ সালের ১৯ নভেম্বর এবং ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর দুই দফায় ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে এসব হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের বিস্তারিত বিবরণ দেন।
এর আগে ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর রাজধানীর বাড্ডার বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন মুফতি হান্নান। এরপর বিভিন্ন মামলায় টানা ১২০ দিন রিমান্ডে ছিলেন তিনি। তখনই গোয়েন্দাদের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে মুফতি হান্নান শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করাসহ বিভিন্ন হামলায় জড়িত থাকার বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ দেন। কিন্তু তা তৎকালীন সরকার প্রকাশ করেনি।
বরং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করে। গোয়েন্দাদের কাছে দেওয়া হান্নানের ওই জবানবন্দি প্রথম ২০০৭ সালের ২১ আগস্ট প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাসহ বিভিন্ন মামলা নতুন করে তদন্তের উদ্যোগ নেয়।
মুফতি হান্নানের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ায়৷ তাঁর জবানবন্দি থেকে জানা যায়, তিনি গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসা ও বরিশালের শর্ষিনা আলিয়া মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন। এরপর ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে দাওরা হাদিস পড়াকালে ১৯৮৭ সালে ওই দেশের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক শিক্ষায় স্নাতকোত্তর পাস করেন। পরের বছর ১৯৮৮ সালে তিনি পাকিস্তানে যান এবং করাচির জামিয়া ইউসুফ বিন নূরিয়া মাদ্রাসায় ফিকাহশাস্ত্রে ভর্তি হন৷ সেখান থেকে তিনি সীমান্তবর্তী শহর খোস্তে মুজাহিদ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধে আহত হয়ে তিনি পেশোয়ারে কুয়েত আল-হেলাল হাসপাতালে ১০ মাস চিকিৎসা নেন। এরপর করাচির ওই মাদ্রাসায় লেখাপড়া শেষ করেন।
মুফতি হান্নান ১৯৯৩ সালে দেশে ফেরেন এবং পাকিস্তানভিত্তিক হরকাতুল মুজাহিদীনের হয়ে তৎপরতা শুরু করেন। অবশ্য এর আগেই আফগানফেরত এদেশীয় মুজাহিদরা হুজি-বি গঠন করেন। মুফতি হান্নান ১৯৯৪ সালে হুজি-বিতে যোগ দেন। প্রথমে তিনি কোটালীপাড়া উপজেলার থানা প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পান। সাংগঠনিক দক্ষতায় অল্প দিনের মধ্যে তিনি হুজি-বির অন্যতম শীর্ষ নেতৃত্বে চলে আসেন। হুজিতে থাকার পাশাপাশি মুফতি হান্নান হরকাতুল মুজাহিদীনের হয়েও কার্যক্রম চালাতেন বলে জানা গেছে।
১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে এ দেশে গোপন জঙ্গি সংগঠন হুজি-বির নাশকতা শুরু হয়। হুজি-বির কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সিদ্ধান্তে মুফতি হান্নান ও মুফতি আবদুর রউফের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় এ হামলা হয় বলে হান্নানের জবানবন্দিতে উল্লেখ রয়েছে। ওই হামলায় ১০ জন নিহত ও দেড় শ জন আহত হন। যদিও তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এ ঘটনায় বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ফলে জঙ্গিদের বিষয়টি তখন আড়ালেই থেকে যায়। এরপর একই বছরের ৮ অক্টোবর খুলনা শহরের আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলা হয়। তাতে আটজন নিহত হন।
২০০০ সালের জুলাইয়ে কোটালীপাড়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভাস্থলের কাছাকাছি ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রেখে প্রথম আলোচনায় আসেন মুফতি হান্নান ও তাঁর দল। এরপর থেকে তিনি আত্মগোপনে থেকে তৎপরতা চালান।
২০০১ সালে ঢাকায় সিপিবির সমাবেশে, রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানসহ ছয়টি বোমা হামলার ঘটনা ঘটায় জঙ্গিরা। এরপর শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালায় ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে তাঁর সমাবেশে। এতে আওয়ামী লীগের ২২ জন নেতা-কর্মী নিহত হন। আহত হন শেখ হাসিনাসহ শতাধিক ব্যক্তি।
তার আগে ওই বছরের ২১ মে সিলেটে হজরত শাহজালাল (র.)-এর মাজারে বাংলাদেশে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর এবং ৭ আগস্ট সিলেটের তৎকালীন মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের ওপর গ্রেনেড হামলা চালায় হুজি-বির জঙ্গিরা। হান্নানের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় সর্বশেষ গ্রেনেড হামলা হয় ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জে এক সমাবেশে। ওই হামলায় আওয়ামী লীগের নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াসহ পাঁচজন নিহত হন।
ঢাকায় আরও সাত মামলা: প্রথম আলোর আদালত প্রতিবেদক জানান, মুফতি হান্নানের বিরুদ্ধে করা আরও সাতটি মামলার বিচার ঢাকার বিভিন্ন আদালতে চলছে। সেগুলো হলো ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় করা দুটি মামলা, রমনার বটমূলে বোমা হামলার ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা মামলা, ২০০০ সালে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বোমা পুঁতে রেখে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় দুটি, ২০০১ সালে সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলার ঘটনায় দুটি মামলা।
দীর্ঘ এত বছরেও এসব চাঞ্চল্যকর মামলার বিচার শেষ না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে ঢাকা মহানগরের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবু আবদুল্লাহ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মুফতি হান্নানসহ এসব মামলার অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে সারা দেশে অনেক মামলা রয়েছে। আসামির উপস্থিতি ছাড়া আদালত সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পারেন না। ঢাকার বাইরের মামলাগুলোর তারিখ দেওয়ার ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এ কারণে একাধিক মামলার তারিখ একই দিনে পড়ছে। ফলে কোনো মামলায় আসামি হাজির করা হলো তো সাক্ষী নেই। আবার কোথাও সাক্ষী হাজির তো আসামিদের অন্য মামলায় নেওয়া হয়েছে, যার কারণে বিচারকাজে বিলম্ব হচ্ছে।
সিলেটে পাঁচ মামলা: প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট জানান, মুফতি হান্নানের বিরুদ্ধে সিলেটের আদালতে বিচারাধীন আছে চারটি মামলা। আর একটি মামলা অধিকতর তদন্ত করছে সিআইডি। সেটি হলো সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার ঘটনায় বিস্ফোরক আইনে করা মামলা।
অপর চারটি মামলা হলো: ২০০৫ সালে হবিগঞ্জে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যার ঘটনায় করা দুটি মামলা, ২০০১ সালে সিলেটে নির্বাচনী জনসভায় শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলা এবং একই বছর সিলেটের তৎকালীন মেয়র বদরউদ্দিন কামরানকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা মামলা।
নারায়ণগঞ্জ ও খুলনায় তিন মামলা: ২০০১ সালে নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে বোমা হামলার ঘটনায় করা দুটি মামলা সেখানকার আদালতে বিচারাধীন আছে। এ ছাড়া ১৯৯৯ সালে খুলনায় আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলার মামলাটি এক দফা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পর আদালতের নির্দেশে ২০১০ সালে আবার পুনরুজ্জীবিত হয়। মামলাটি এখন তদন্তাধীন আছে।
আরও পড়ুন:মুফতি হান্নানসহ তিন জঙ্গির ফাঁসি বহাল