ঢিমেতালে চলছে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র

.
.

নানা হাঁকডাক, শোরগোল, ‘এই রিকশা বাঁয়ে চাপা’; ‘নামেন নামেন, আইসা পড়ছি’; ‘এই সদরঘাট, সদরঘাট’; ‘মামা কম দিতে পারতেন না, এক দাম ১২০।’ সঙ্গে মানুষের ভিড়, যানবাহনের জট।
এসবই জায়গাটার প্রতিদিনের চিত্র। কারণ, এটি রাজধানীর ব্যস্ততম গুলিস্তান। এই গুলিস্তানেই গোলাপ শাহ মাজারের ঠিক সামনে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। ‘জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও গ্রন্থমনস্ক জাতি গঠনের লক্ষ্যে’ প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল আগে যার যাত্রা শুরু।
অনেকে মনে করেন, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র প্রকাশনা শিল্পের বিকাশ সাধনে ভূমিকা পালনকারী মূল প্রতিষ্ঠান। তবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন এই প্রতিষ্ঠানটি কিছুদিন ধরে চলছে কিছুটা ঢিমেতালে। ঝিমিয়ে পড়েছে কিছু উদ্যোগ। প্রতিষ্ঠানটির কাজকর্ম নিয়ে অনেকেরই নেই স্পষ্ট ধারণা। প্রকাশনা শিল্প-সংশ্লিষ্ট সবাই বলছেন, গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানটির পুনরুজ্জীবন খুব দরকার। দরকার একে ঢেলে সাজানো।

গ্রন্থকেন্দ্র সূত্রে জানা গেল, ইউনেসকোর ঘোষণা ও জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সুপারিশে ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল বুক সেন্টার ফর পাকিস্তান। ঢাকায় খোলা হয় এর একটি শাখা কার্যালয়। স্বাধীনতার পর এর নামকরণ হয় ‘জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র বাংলাদেশ’। ১৯৯৫ সালে পাস হয় এ-বিষয়ক আইন। আর প্রবিধানমালা হয় আরও ১০ বছর পর ২০০৫ সালে। গুলিস্তানে নিজস্ব ভবনে এর কার্যক্রম চলছে ১৯৭৮ সাল থেকে।

আসলে তাঁরা কী কী করেন—জানতে চাওয়া হয় পরিচালক মো. আখতারুজ্জামানের কাছে। বললেন, দেশে বিপুলসংখ্যক পাঠক সৃষ্টি, বেসরকারি গ্রন্থাগারের উন্নয়ন ও পৃষ্ঠপোষকতা দান, সরকারি অনুদানের বই ও অর্থ গ্রন্থাগারে সরবরাহ, দেশে বইমেলার আয়োজন, বিদেশে বইমেলায় অংশগ্রহণ, সেমিনার-আলোচনা সভার আয়োজনই মূল কাজ। নীরবে-নিভৃতেই কাজ করছেন তাঁরা।

আখতারুজ্জামান বললেন, এর বাইরে এমন কিছু উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, যাতে মানুষ খুব শিগগির গ্রন্থকেন্দ্রের তৎপরতা সম্পর্কে জানতে পারবে।

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে বইমেলার আয়োজন করলেও বন্ধ রয়েছে ঢাকা বইমেলা। জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা বললেন, মানুষের সব আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকে একুশের গ্রন্থমেলা। বড় পরিসরে এ মেলা হওয়ায় এর আগে আরেকটি মেলার দিকে পাঠক-দর্শকের আগ্রহ স্বাভাবিকভাবে কম থাকে। এসব বিবেচনা করে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে স্থগিত রাখা হয়েছে ঢাকা বইমেলা। সর্বশেষ ২০১৩ সালে আয়োজন করা হয় ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা।

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে প্রকাশিত হচ্ছিল দেশের অন্যতম প্রাচীন মননশীল পত্রিকা বই। প্রকাশনার ৪৬ বছরে এসে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে স্থগিত রয়েছে বই-এর প্রকাশনা। তবে অচিরেই আবার এর প্রকাশ শুরু হবে বলে আশাবাদ জানালেন প্রতিষ্ঠানের সহকারী পরিচালক মানিক মাহমুদ।

সরেজমিনে জানা গেল, ‘গ্রন্থ ভবন’ নামে পরিচিত পাঁচতলা এ ভবনে রয়েছে মহানগর পাঠাগার নামে একটি লাইব্রেরি, মেলা ও বেসরকারি গ্রন্থাগারে বই সরবরাহের জন্য একটি ‘সেলস সেন্টার’। রয়েছে ১২০ আসনের একটি মিলনায়তন। খুব শিগগির নিচতলায় চালু হতে যাচ্ছে আধুনিক বই বিক্রয় ও বিপণন কেন্দ্র।

গ্রন্থকেন্দ্রের অন্য কাজের মধ্যে রয়েছে প্রতিবছর প্রকাশিত নতুন বইয়ের তালিকা প্রণয়ন, বেসরকারি গ্রন্থাগার নির্দেশিকা প্রকাশ, প্রকাশকপঞ্জি বের করা এবং প্রকাশক, গ্রন্থাগারিক, পুস্তক সম্পাদনা ও ইলাস্ট্রেশন নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া।

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালনা বোর্ডের অন্যতম সদস্য, সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সাহিত্য প্রকাশের পরিচালক মফিদুল হক মনে করেন, সরকার, বেসরকারি খাত এবং লেখক-পাঠক গোষ্ঠীর মধ্যে সেতুবন্ধ রচনা করে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। তাই এই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকার কোনো বিকল্প নেই। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘প্রকাশনা শিল্পের বিকাশ সাধনে ভূমিকা পালনকারী মূল প্রতিষ্ঠান জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। তবে যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গি, নীতি ও এর বাস্তবায়নে উপযুক্ত সমর্থনের অভাবে প্রতিষ্ঠানটি ক্রমে স্থবির হয়ে পড়েছে। সবার স্বার্থেই গ্রন্থকেন্দ্রের পুনরুজ্জীবন দরকার।’

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে ঢেলে সাজানো দরকার বলে মনে করেন বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ওসমান গনি। তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে পরিচালক পদটিতে এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া উচিত, যাঁর রক্তের মধ্যে বই আছে। বইয়ের প্রতি ভালোবাসা আছে।’ ভেবেচিন্তে নিয়োগ না দেওয়ায় বারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

ওসমান গনি বলেন, গ্রন্থমনস্ক জাতি গঠনে প্রতিষ্ঠানটি যদি উদ্যোগ নিতে চায়, তবে এর দিকে সরকারের নজর দিতে হবে সবার আগে।

শুরু থেকে গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক পদে বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক বা আমলাদের কেউ দায়িত্ব পালন করেছেন। কবি অসীম সাহা তাঁর নিয়োগের দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ না করে গত বছর সরে দাঁড়ান। জানতে চাইলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, আমলাতন্ত্রের অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ প্রতিষ্ঠানটিতে স্বাধীনভাবে কাজ করার প্রধান বাধা। বাধ্য হয়ে তাঁকে প্রতিষ্ঠানটি ছেড়ে আসতে হয়েছে।