বেসিক ব্যাংক ঋণ জালিয়াতিতে আবদুল হাইয়ের সংশ্লিষ্টতা ছিল

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) রাষ্ট্রমালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারিতে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়নি। কিন্তু অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংসদকে জানিয়েছেন, ঋণ জালিয়াতিতে শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা ছিল।
গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে টেবিলে উপস্থাপিত প্রশ্নোত্তর পর্বে জাতীয় পার্টির সেলিম উদ্দিনের লিখিত প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী এ কথা বলেন। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন।
অর্থমন্ত্রী এ সময় লিখিতভাবে জানান, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক কর্তৃক নিয়োগকৃত বহিঃনিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানদ্বয়ের দাখিলকৃত কার্যভিত্তিক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে অনিয়মিত ঋণ মঞ্জুর, নিয়োগ ও পদোন্নতিতে তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে উল্লেখ রয়েছে।’
অর্থমন্ত্রী আরও জানান, বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে ২৭ জন কর্মকর্তা, ৫৬টি ব্যবসায়িক ও আটটি সার্ভেয়ার প্রতিষ্ঠান জড়িত ছিল। তিনি এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তালিকাও উপস্থাপন করেন।
উল্লেখ্য, ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে বেসিক ব্যাংকের গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখা থেকে মোট সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে লেখালেখি হলে বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করা হয়। তবে এর আগে আবদুল হাই বাচ্চুকে পদত্যাগের সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর অনুসন্ধানে নামে দুদক।
দুদক চার বছর অনুসন্ধানের পর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির ঋণ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৫৬ জনকে আসামি করে ৫৬টি মামলা করে। মামলায় বেসিক ব্যাংকের ২৬ কর্মকর্তাকে আসামি করা হলেও ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু ও পরিচালনা পর্ষদের কোনো সদস্যের কোনো নাম নেই। মামলায় ব্যাংক কর্মকর্তার বাইরে অপর আসামিরা হলেন ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা।
অর্থমন্ত্রী এর আগেও একাধিকবার বেসিক ব্যাংক জালিয়াতির জন্য শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর নাম বলেছিলেন। যেমন, অর্থমন্ত্রী গত বছরের ৮ জুলাই সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘যতই ক্ষমতাশালী হোক না কেন, বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে আইনের আওতায় আনা হবে।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘ব্যাংকটিতে হরিলুট হয়েছে। আর এর পেছনে ছিলেন ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। তাঁর ব্যাংকবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের কারণেই বেসিক ব্যাংক সমস্যায় জর্জরিত হয়েছে। তাঁর ব্যাংকবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে। এখন তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কোনো সমস্যা হবে না।’ এরও আগে গত ৩০ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী হল-মার্ক কেলেঙ্কারি ও বেসিক ব্যাংক জালিয়াতি নিয়ে বলেছিলেন, ‘জালিয়াতদের ধরতে বাধা নিজের দলের লোক।’ এরপরও দুদক আবদুল হাই বাচ্চুর কোনো সংশ্লিষ্টতা পায়নি।
অর্থমন্ত্রীর লিখিত বক্তব্য অনুযায়ী ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা হলেন ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম সাজেদুর রহমান ও কাজী ফখরুল ইসলাম, সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মঞ্জুর মোরশেদ, সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুস সোবহান, কনক কুমার পুরকায়স্থ, এ মোনায়েম খান (সাময়িক বরখাস্ত) ও মো. সেলিম, মহাব্যবস্থাপক জয়নুল আবেদিন চৌধুরী, মোজাম্মেল হোসেন, খন্দকার শামীম হোসেন (সাময়িক বরখাস্ত), মনিরুজ্জামান, গোলাম ফারুক খান ও মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আলী (চাকরিচ্যুত), সাবেক উপমহাব্যবস্থাপক কোরবান আলী, ওমর ফারুক, শিপার আহমেদ (চাকরিচ্যুত), এস এম ওয়ালিউল্লাহ (সাময়িক বরখাস্ত), সহকারী মহাব্যবস্থাপক জহির উদ্দিন, ইমরুল ইসলাম, আবদুস সবুর, আবদুস সাত্তার খান, পলাশ দত্ত গুপ্ত, ইকরামুল বারী ও সরোয়ার হোসেন, ব্যবস্থাপক মুহিবুল হক এবং উপব্যবস্থাপক এস এম জাহিদ হাসান (চাকরিচ্যুত) ও এন এ তোফিকুল আলম।
জড়িত ৫৬টি প্রতিষ্ঠান হলো আজাদ ট্রেডিং, ভাসাবি ফ্যাশন, তাহমিনা ডেনিম, লাইফস্টাইল ফ্যাশন মেকার, ইউকে বাংলা ট্রেডিং, তাহমিনা নিটওয়্যার, ফারশি ইন্টারন্যাশনাল, খাদিজা অ্যান্ড সন্স, লিটল ওয়ার্ল্ড, এআরএসএস এন্টারপ্রাইজ, আমিরা শিপিং এজেন্সি, এশিয়ান শিপিং বিডি, এসএফজি শিপিং লাইন, মনিকা ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল, ফাস্ট অ্যান্ড বেস্ট ট্রেড ইমপেক্স, ট্রেড হাউস, এশিয়ান ফুড ট্রেডিং, সুরমা স্টিল অ্যান্ড স্টিলট্রেডিং, সিলভার কম ট্রেডিং, সিনট্রেক্স, বি. আলম শিপিং লাইনস, এস এল ডিজাইনার, তানজিনা ফ্যাশন, ফিয়াজ এন্টারপ্রাইজ, নাহার গার্ডেন, এলআর ট্রেডিং, সৈয়দ ট্রেডার্স, রুদ্র স্পেশালাইজড কোল্ড স্টোরেজ, নিউ অটো ডিফাইন, টেলিউইজ ইন্টারন্যাশনাল, ডায়নামিক ট্রেডিং, আহমেদ ওয়েলস মিলস, বীথি এন্টারপ্রাইজ, ওমারেল্ড স্পেশালাইজড কোল্ড স্টোরেজ, এমারেল্ড অটো ব্রিকস, প্রোপেল ইন্টারন্যাশনাল, আরআই এন্টারপ্রাইজ, গুঞ্জন এগ্রো এরামেটিক অটো রাইস মিল, হক ট্রেডিং, ভয়েস এন্টারপ্রাইজ, হাসিব এন্টারপ্রাইজ, এস ও এস ব্রাদার্স, আলী কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড সাপ্লায়ার্স, বাশার এন্টারপ্রাইজ, এমারেন্ড ওয়েল, সিমেক্স, আর কে ফুডস, সৈয়দ রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ডেভোলপারস, রিলায়েন্স শিপিং লাইনস, সৈয়দ কনস্ট্রাকস, নীল সাগর এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ, নীল সাগর এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ (ফিড মিল ইউনিট), পারমা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়াকর্স, এমারেল্ড ড্রেস, বর্ষণ এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ ও আজবিহা এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ।
জড়িত সার্ভেয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো হলো এসবি সার্ভে ফার্ম, রূপসা সার্ভেয়ার, পিএসআর, বিডিএস অ্যাডজাস্টার, ইউনিক সার্ভে সার্ভিস ব্যুরো, প্রফেশনাল অ্যাসোসিয়েটস, দেশ পরিদর্শন কোং ও আইএইচএস ইন্সপেকশন।