তলিয়ে গেছে সাড়ে সাত হাজার একরের বোরো

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানিতে সুনামগঞ্জের দুটি বড় হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে প্রায় পাঁচ হাজার একর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে। শনির হাওরের জালখালি এলাকার ফসল রক্ষা বাঁধটি গতকাল সোমবার সকাল নয়টায় ভেঙে যায়। আর নলুয়ার হাওরের বাঁধ ভেঙে রোববার সন্ধ্যা থেকে পানি ঢুকে ধান তলিয়ে যায়।

এদিকে বাঁধ ভেঙে ধরমপাশা উপজেলার তিনটি হাওরের ২ হাজার ৬৬৭ একর জমির বোরো তলিয়ে গেছে। গতকাল সোমবার সকালে উপজেলার সাতারিয়া ও পাথারিয়া এবং ধারাম হাওরে পানি ঢুকে পড়ে। গতকাল ভোর ছয়টার দিকে সাতারিয়া ও পাথারিয়া এবং সকাল আটটার দিকে গাগলাখালী বাঁধে ভাঙন দেখা দেয়। জমিতে পানি ঢুকে পড়ায় নিরুপায় হয়ে কৃষকেরা আধপাকা ধান কাটা শুরু করেছেন।

স্থানীয় প্রশাসন, কৃষক ও জনপ্রতিনিধি সূত্রে জানা গেছে, শনির হাওরটি জেলার তাহিরপুর, জামালগঞ্জ ও ধরমপাশা উপজেলায় বিস্তৃত। সকাল নয়টার দিকে হাওরের জালখালি এলাকার ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকতে শুরু করে। খবর পেয়ে উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা সেখানে ছুটে যান। কৃষকদের নিয়ে দুপুরের পর থেকে বাঁধটি রক্ষায় কাজ শুরু করা হয়।

তাহিরপুর উপজেলার উজান তাহিরপুর গ্রামের বাসিন্দা শিক্ষক গোলাম সরোয়ার বলেন, ‘এ বছর অসময়ে অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সমস্যা হয়েছে বেশি। যেভাবে পানি ঢুকছে, তাতে এই হাওর রক্ষা করা কঠিন হবে।’

রোববার সন্ধ্যায় ভুরাখালি দক্ষিণের বাঁধ ভেঙে জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়ার হাওরে পানি ঢুকে ফসল তলিয়ে যায়। রাতে বৃষ্টি হওয়ায় এই বাঁধ রক্ষায় কোনো কাজ করা যায়নি। হাওরপারের ভুরাখালি গ্রামের কৃষক কাছা মিয়া বলেন, ‘সকালে ঘুম থাকি উঠি দেখি, হাওরে ধান দেখা যায় না, শুধু পানি আর পানি। সব সাদা অইগিছে। আমরা কোনো ধান কাটতে পারছি না।’

জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মুক্তাদীর আহমদ বলেন, ‘এই হাওরটি রক্ষায় সবাই চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর রক্ষা করা গেল না। এই হাওরের কিছু ধান কৃষকেরা কাটতে পেরেছেন। তারপরও এখানে কমপক্ষে দুই হাজার একর জমির ধান পানিতে তলিয়ে গেছে।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. ফিরোজ খান জানান, তাঁদের হিসাবমতে সুনামগঞ্জ জেলায় গত নয় দিনে পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে এবং জলাবদ্ধতা ও শিলাবৃষ্টিতে ২৮ হাজার ৭২ একর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেবল রোববার ও গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত বাঁধ ভেঙে ৬ হাজার ১৭৫ একর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে জগন্নাথপুরের নলুয়ার হাওরে ১ হাজার ৩০০ একর। শনির হাওরের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব তাঁরা গতকাল সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত পাননি।

ধরমপাশা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এবার জয়শ্রী ইউনিয়নের সাতারিয়া ও পাথারিয়া হাওরে ৭৭৬ একর বোরো জমিতে ধান চাষ করা হয়। এর মধ্যে ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে এই দুই হাওরের ৪৫৫ একর বোরো জমির ধান পানিতে তলিয়ে যায়। একই দিন সকাল আটটার দিকে উপজেলার জয়শ্রী ইউনিয়নের অংশে গাগলাখালী ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে যায়। এই বাঁধের আওতায় ধারাম হাওরে ধরমপাশা সদর, সুখাইড় রাজাপুর দক্ষিণ ইউনিয়ন ও জয়শ্রী—এ তিনটি ইউনিয়নের কৃষকদের ২ হাজার ২১৩ একর জমির পাকা ও আধপাকা ধান পানিতে তলিয়ে গেছে।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার জয়শ্রী ইউনিয়নের সাতারিয়া-পাথারিয়া হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের ভাঙা বন্ধকরণ ও মেরামতকাজের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ছয় লাখ টাকা। প্রকল্প চেয়ারম্যান ছিলেন জয়শ্রী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান মহসীন আহমেদ। গাগলাখালী ফসলরক্ষা বাঁধের মেরামতকাজের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। প্রকল্প চেয়ারম্যান ছিলেন জয়শ্রী ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. লোকমান মিয়া।

উপজেলার জয়শ্রী ইউনিয়নের বানারসীপুর গ্রামের কৃষক নওয়াব আলী অভিযোগ করেন, ‘চেয়ারম্যান মহসীন আহমেদ এই বান্দে ভালা কইর‌্যা কাম না করনে আমরার এই সর্বনাশটা অইছে। নিরপায় অইয়া আমরা নিজেরাই বান্দে কাম করছি।’

ধরমপাশা সদর ইউনিয়নের ধারাম হাওরপাড়ের কান্দাপাড়া গ্রামের কৃষক কাঞ্চন মিয়া বলেন, ‘বান্দে সময়মতো কাম অইছে না। এই হাওরে জমিতে ধান রোপণ করছিলাম। এক মুষ্টি ধানও ঘরে তুলতাম হারছি না। বান্দে ঠিকমতো কাম অইলে এই গজবডা আমরার অইত না।’

জয়শ্রী ইউপি চেয়ারম্যান মহসীন আহমেদ ও ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য লোকমান মিয়া দাবি করেন, ‘ফসলরক্ষা বাঁধে আমরা সঠিকভাবেই কাজ করেছি। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানির চাপে বাঁধ ভেঙে ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে।’

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শোয়েব আহমেদ বলেন, পাহাড়ি ঢলের পানির প্রবল চাপে আগাম বন্যা দেখা দেওয়ায় এ উপজেলায় এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ৭৬০ একর বোরো জমির ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। নিরুপায় হয়ে কৃষকেরা জমির আধপাকা ধান কাটছেন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাজমুল হক বলেন, পাহাড়ি ঢলের পানির চাপ বেশি থাকায় নদীতে পানি বেড়ে গেছে। স্থানীয় জনগণ জনপ্রতিনিধি, পাউবোসহ সবাই হাওরের ফসল রক্ষায় কাজ করছেন।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় হাওরে ফসল ডুবে গেছে। হাওরের দ্রুত ফসল কেটে ফেলার জন্য মাইকযোগে প্রচার চালানো হচ্ছে। হাওরের বোরো ফসল ও বাঁধ রক্ষায় আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি।’