বাসভাড়া কমছে নামমাত্র

জ্বালানির দাম বাড়লে এক রকম হিসাব, আর কমলে আরেক রকম। ডিজেলের দাম কমার পরিপ্রেক্ষিতে পরিবহনমালিকেরা বাসভাড়া কমানোর ক্ষেত্রে যে অবস্থান নিলেন, তাতে এ প্রবণতাই প্রকাশ পেল। ডিজেলের মূল্য তিন টাকা কমানোর পরিপ্রেক্ষিতে দূরপাল্লার বাসভাড়া প্রতি কিলোমিটারে তিন পয়সা কমানোর প্রস্তাব করেছে বিআরটিএর ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি। অথচ ২০১২ সালে ডিজেলের মূল্য ৫ টাকা টাকা বাড়ার সূত্র ধরে বাসভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১৫ পয়সা বাড়ানো হয়েছিল।
গতকাল সোমবার সকালে ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি বৈঠক করে তাদের প্রস্তাব সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। মন্ত্রণালয় পরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে।
প্রস্তাবে দেখা যাচ্ছে, প্রতি লিটার ডিজেলের দাম এক টাকা হ্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে বাসভাড়া ১ পয়সা কমানোর মানদণ্ড দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন বাসমালিকেরা। এ হিসাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রুটে একজন যাত্রীর ভাড়া কমবে সাত থেকে আট টাকা।
বাসভাড়া কমানোর এই প্রস্তাব কেবল দূরপাল্লার বাসের জন্য প্রযোজ্য। রাজধানীর ভেতরে বাসভাড়া কমানোর কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
তবে এই নামমাত্র মূল্যহ্রাস আদৌ কার্যকর হবে কি না, এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন যাত্রীরা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্র জানায়, জ্বালানির মূল্য এক টাকা কমলে ভাড়া এক পয়সা কমবে—এই রীতি মেনে ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি মন্ত্রণালয়ে নতুন ভাড়ার প্রস্তাব পাঠিয়েছে। ২০০৮ ও ২০০৯ সালে দুই দফায় জ্বালানির মূল্য ১১ টাকা কমানো হয়। সে সময় পরিবহনের ভাড়া ১১ পয়সা কমানো হয়েছিল। হিসাবের এই রেওয়াজ ওই নজির থেকেই এসেছে।
অভিযোগ রয়েছে, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি পেলে এই রেওয়াজ মানা হয় না। তখন ব্যয় বিশ্লেষণে নতুন নতুন বিবেচনা যুক্ত করেন মালিকেরা। ২০১২ ও ২০১৩ সালে দুই দফায় ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধি পায় ১৫ টাকা। ব্যয় বিশ্লেষণের নামে দুই দফায় সরকার দূরপাল্লার পথে ভাড়া বাড়িয়েছিল মোট ২৫ পয়সা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানির দাম বাড়লে এর সঙ্গে আরও ১৮টি ব্যয়ের খাত বাড়িয়ে ধরে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। এরপর সরকার যা বৃদ্ধি করে, তার কয়েক গুণ বাড়িয়ে আদায় করেন মালিকেরা। অতীতে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেটসহ বিভিন্ন পথে ২০ টাকা ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্তের পর মালিকেরা ৮০-৯০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি নিয়েছেন। বিপরীতে জ্বালানির দাম কমলে শুধু জ্বালানি খরচ আমলে নেওয়া হয়। এরপরও সরকারি সিদ্ধান্ত মেনে কেউ ভাড়া কমান না। এবারও সে রকমই আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পরিবহনের ভাড়া নির্ধারণে বিআরটিএর ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটির প্রধান পদাধিকারবলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান। ১২ সদস্যের এই কমিটিতে চারজনই মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতা। বাকিরা বিআরটিএসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা। একজন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রতিনিধি। বৈঠকে সব সময় অংশ নেন এমন একাধিক সদস্য জানান, ব্যয় বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মালিক-শ্রমিক নেতারাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।
তিন পয়সা ভাড়া কমলে দূরের কয়েকটি গন্তব্য ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যাত্রীপ্রতি ভাড়া কমবে ১০ থেকে ১৫ টাকা। যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনের নেতা ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তারা মনে করছেন, তিন পয়সা ভাড়া কমলে মালিকেরা তা কার্যকর করতে চাইবেন না। কারণ, অধিকাংশ বাসের ভাড়াই পূর্ণ সংখ্যার (১০ কিংবা ২০ টাকার খণ্ডিত ভাড়া রাখা হয় না)। তাই সরকারের নজরদারি ছাড়া ভাড়া কমলেও যাত্রীরা এর সুবিধা পাবেন না।
বিআরটিএ সূত্র থেকে জানা যায়, তিন পয়সা ভাড়া কমানোর প্রস্তাব রাজধানী ঢাকার জন্য প্রযোজ্য হবে না। বিআরটিএর কর্মকর্তা ও পরিবহনমালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকায় চলাচলকারী বাস-মিনিবাসের একটা বড় অংশই চলে ডিজেলে। অতীতে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির পর সরকার ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত না নিলেও মালিকেরা নিজ উদ্যোগে বৃদ্ধি করেছেন।
বিআরটিএ সূত্রে আরও জানা যায়, পরিবহনমালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো কিলোমিটারপ্রতি দুই পয়সা কমানোর প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু বিআরটিএর চেয়ারম্যানসহ কর্মকর্তারা তিন পয়সা কমানোর পক্ষে মত দেন। পরে সন্ধ্যায় কমিটির প্রস্তাব হিসেবে তিন পয়সা কমানোর প্রস্তাব করা হয়।
জানতে চাইলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কমিটি তিন পয়সা কমানোর প্রস্তাব করে তা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করবে। তিনি দাবি করেন, ঢাকায় ডিজেলচালিত বাস-মিনিবাস চলে না।
ভাড়া কমানোর পর তা বাস্তবায়নে প্রস্তুতি কী জানতে চাইলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান বলেন, পুলিশ, জেলা প্রশাসন ও বিআরটিএ তো আছেই। সবাই মিলেই পর্যবেক্ষণ করা হবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব ও ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটির সদস্য খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে যে সাশ্রয় হয়েছে, ভাড়া তিন পয়সা কমালে পরিবহনমালিকদের লোকসান হবে। দুই পয়সা কমালে ঠিক হবে। রাজধানীতে ভাড়া না কমানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এমনিতেই ঢাকায় মালিকেরা লসে আছেন। ভাড়া কমালে পরিবহন বন্ধ হয়ে যাবে।’