ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার দায় বেশি গাড়িচালকের

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে গত ২৮ মাসে ২১৭টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রেলক্রসিং পারাপারের সময় ট্রেন-গাড়ি সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩৬ জন। বেশির ভাগ দুর্ঘটনার জন্য যানবাহনচালকদের অসচেতনতাকেই দায়ী করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ গঠিত বিভিন্ন তদন্ত কমিটি।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাপরিচালকের কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে ৬৫টি রেল দুর্ঘটনায় মারা গেছে ১৫ জন। ২০১৪ সালে দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৪৭টি। মারা যায় ১৯ জন। এ বছরের জানুয়ারি থেকে ১৬ মে পর্যন্ত পাঁচটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। মারা গেছে দুজন। গত সাড়ে ২৮ মাসে পূর্বাঞ্চল রেলওয়েতে দুর্ঘটনায় যত প্রাণহানি ঘটেছে, তার বেশির ভাগই হয়েছে রেলক্রসিংয়ে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগ নিয়ে রেলের পূর্বাঞ্চল গঠিত।
পূর্বাঞ্চল রেলে সর্বশেষ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে গত সোমবার চট্টগ্রাম নগরের ষোলোশহর রেলক্রসিংয়ে। সেদিন ট্রেন (তেলবাহী ওয়াগন) ও বাসের সংঘর্ষে দুই নারী নিহত হন। আহত হয় আরও ১০ জন। এ দুর্ঘটনার পরও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ গঠিত তদন্ত কমিটি প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর বাসচালকের অসতর্কতাকে দায়ী করেছে।
গত দুই বছরে রেলক্রসিংয়ে ২৮টি বড় দুর্ঘটনার পর রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ গঠিত তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেছে প্রথম আলো। এতে দেখা যায়, ২৫টি দুর্ঘটনার জন্যই যানবাহনচালকদের দায়ী করেছে রেলের তদন্ত কমিটি। কেবল একটি দুর্ঘটনার জন্য গেটম্যানকে দায়ী করা হয়েছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ফৌজদারহাট এলাকার একটি ক্রসিংয়ে মিনি ট্রাকের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষ হয়। সঠিক সময়ে গেট না ফেলায় ট্রাকচালক ট্রেন আসার বিষয়টি বুঝতে পারেননি। ফলে ক্রসিং অতিক্রম করতে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ট্রাকটি। এতে নিহত হন একজন। তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ওই গেটম্যানকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ২৮টি তদন্ত প্রতিবেদনের মধ্যে একটি দুর্ঘটনার কোনো কারণ বের করতে পারেনি কমিটি। এ বছরের ২২ এপ্রিল চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের অদূরে অবৈধ একটি লেভেল ক্রসিংয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। একটি প্রাইভেট কার তখন রেলক্রসিং পার হচ্ছিল। সংঘর্ষ এড়াতে ট্রেনের চালক হঠাৎ ব্রেক করলে চার চাকা লাইনচ্যুত হয়। এ ছাড়া ২০১৫ সালের ২৫ আগস্ট সীতাকুণ্ডের একটি ক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে লরির সংঘর্ষে একজন নিহত হন। এ দুর্ঘটনার তদন্ত এখনো চলছে।
চট্টগ্রামের ষোলোশহর রেলক্রসিংয়ে গেটম্যান দায়িত্বে থাকার পরও দুর্ঘটনা ঘটেছে। গেটম্যান ক্রসিংয়ে লোহার খুঁটি (প্রতিবন্ধক) ফেলতে দেরি করেছেন বলে দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেছেন। তবে গেটম্যান হাবিবুর রহমান এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সংকেত অমান্য করে বাসচালক গেট ফেলার আগেই রেললাইনের ওপর উঠে যায়। তাঁকে পিছিয়ে আসতে বলা হলেও তিনি (বাসচালক) শোনেননি।
এ বিষয়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) আবদুল হাই দাবি করেন, কেবল ষোলোশহর নয়, এর আগে বিভিন্ন সময়ে রেলক্রসিংয়ে যত দুর্ঘটনা ঘটেছে, এর জন্য গাড়িচালকদের অসচেতনতা ও অসহিষ্ণুতাই বেশি দায়ী। গাড়িচালকেরা ধৈর্য ধরতে চান না। তবে কিছু ব্যতিক্রম আছে। কয়েকটি দুর্ঘটনার জন্য রেলের কর্মীদেরও দায় রয়েছে।
মহাব্যবস্থাপক আবদুল হাই বলেন, গত নয় মাসে ষোলোশহর রেলক্রসিংয়ের ঘটনাটি ছাড়া পূর্বাঞ্চলে বড় কোনো দুর্ঘটনা নেই। এর কারণ রেললাইনের ডাবল ট্র্যাক (বিদ্যমান লাইনের পাশে আরেকটি লাইন) চালু হওয়া। পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন স্টেশনে শূন্যপদে স্টেশনমাস্টার নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হলে দুর্ঘটনা আরও কমে আসবে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, স্টেশনমাস্টাররা নিজ স্টেশনের উভয় দিকে ক্রসিংগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন। ক্রসিংয়ে দায়িত্ব পালন করা গেটম্যানদের তদারক করেন স্টেশনমাস্টার। ফলে ক্রসিংয়ে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে স্টেশনমাস্টার এর দায় এড়াতে পারেন না।
২০১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর ঢাকার গেন্ডারিয়া রেলক্রসিংয়ে ট্রেন-কাভার্ড ভ্যান সংঘর্ষে ছয়জন নিহত ও নয়জন আহত হয়। গেন্ডারিয়া দুর্ঘটনার প্রতিবেদনে কাভার্ড ভ্যানের চালককে দায়ী করা হয়েছে। এতে বলা হয়, গেটম্যান ও নিরাপত্তাকর্মীদের নির্দেশ অমান্য করে কাভার্ড ভ্যানটি বেপরোয়াভাবে ক্রসিং পার হচ্ছিল।
২০১৫ সালের আগস্টে বাড়বকুণ্ড ক্রসিংয়ে সংঘটিত দুর্ঘটনায় কেউ মারা যায়নি। তবে ওই দুর্ঘটনায় গুঁড়া দুধবাহী কাভার্ড ভ্যানের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষের পর দিনভর ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। তদন্ত কমিটি এই দুর্ঘটনার জন্য গেটম্যান বিপ্লব বড়ুয়াকে দায়ী করে। পরে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
গত বছরের ২৩ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি রেলক্রসিংয়ের গেট ফেলার সময় পাথরবোঝাই একটি ট্রাক লাইনে উঠে যায়। কিন্তু লাইনে ওঠার পর হঠাৎ ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্রসিং পার হতে পারেনি ট্রাকটি। এ সময় ট্রাকের পেছনের অংশে ধাক্কা দেয় ট্রেন। এ দুর্ঘটনার জন্য ট্রাকচালককে দায়ী করে তদন্ত কমিটি।
রেলের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা ফিরোজ ইফতেখার বলেন, বিভিন্ন স্টেশনের পাশে থাকা রেলক্রসিংয়ে যাতে দুর্ঘটনা না ঘটে, সে জন্য কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করতে তাঁরা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, গত সাড়ে চার মাসে ষোলোশহর ক্রসিংয়ের দুর্ঘটনা বাদ দিলে বড় কোনো ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেনি।