কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলার উত্তর ধুরুং ইউনিয়নের ফয়জানীবাপেরপাড়া। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায় ৪০-৫০টি ভাঙা ঘরবাড়ি পড়ে আছে। বাড়িগুলোতে কোনো বাসিন্দা নেই। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে বেড়িবাঁধ ভেঙে এসব ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। আশপাশের কিছু উঁচু জমিতে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু গাছ জানান দিচ্ছে সেখানে একসময় ঘরবাড়ি ছিল।
স্থানীয় গ্রাম পুলিশ কবির আহমদ বলেন, ভাঙা ঘরবাড়িতে থাকার পরিবেশ নেই। এ ছাড়া বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় সামনে জোয়ারের সময় পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। এই আশঙ্কায় ঘরবাড়ি ফেলে লোকজন পেকুয়া, চকরিয়া, বাঁশখালী ও চট্টগ্রাম শহরে চলে গেছে। তিনি বলেন, এ ছাড়া দুবেলা খাবার জোটানোর মতো কোনো কাজ নেই এখানে।
স্থানীয় সূত্রমতে, শুধু ফয়জানীবাপেরপাড়া থেকে নয়, নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে জন্মভিটা ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি জমাচ্ছে কুতুবদিয়ার হাজারো মানুষ। ইতিমধ্যে উপজেলার উত্তর ধুরুং, আলীআকবরডেইল ও কৈয়ারবিল ইউনিয়ন থেকে অন্তত ১০ হাজার মানুষ উপজেলা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। গৃহহীন আরও অনেক মানুষ জন্মভিটা ত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
গতকাল আকবরবলীপাড়া, জহির আলী সিকদারপাড়া, চাটিপাড়া ও চুল্লারপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, হাজারো ঘরবাড়ি ও অঙিনায় হাঁটু পরিমাণ কাদামাটির স্তর জমে আছে। আকবরবলীপাড়ার লবণচাষি সিরাজ উদ্দিন বলেন, ‘১২ জুন থেকে পূর্ণিমার জোয়ার শুরু হবে। তখন কী করব ভেবে পাচ্ছি না।’
মাদ্রাসাশিক্ষক জাকের হোসেন ও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক সদস্য আবদুল শুক্কুর বলেন, পাঁচ-ছয় ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হলে কুতুবদিয়ার কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ দ্বীপের চারদিকে ২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভাঙা।
গত বুধবার বিকেলে কুতুবদিয়ার বড়ঘোপ জেটিতে গিয়ে দেখা মেলে অনেক পরিবারের, যারা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে জন্মভিটা ত্যাগ করছে।
দুই ছেলেকে নিয়ে নৌকার জন্য অপেক্ষারত কৈয়ারবিল ইউনিয়নের সাগরপাড়ার গৃহবধূ কনিকা বালা (৩৫) বলেন, রোয়ানুর আঘাতে তাঁর বাড়ি ভেঙে গেছে। এলাকায় থাকার উপায় নেই। ১০ দিন আগে স্বামী ঝন্টু চট্টগ্রামে পাড়ি জমিয়েছেন। পোশাক কারখানায় চাকরি পেয়েছেন তিনি। এখন ছেলেদের নিয়ে তিনিও সেখানে চলে যাচ্ছেন।
এক ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে জেটিতে নৌকার অপেক্ষায় ছিলেন আলীআকবরডেইল গ্রামের গৃহবধূ হালিমা বেগম (৩৫)। তিনি যাবেন চকরিয়ায়। তাঁর স্বামী বাদশা মিয়া সাত দিন আগে সেখানে গিয়ে থাকার ব্যবস্থা করেছেন।
কেন জন্মভিটা ত্যাগ করছেন জানতে চাইলে হালিমা বেগম বলেন, ‘ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। আয়রোজগারও বন্ধ। এই বর্ষায় জোয়ারে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। তাই আগেভাগে নিরাপদ জায়গায় চলে যাচ্ছি।’
উত্তর ধুরুং ইউপি চেয়ারম্যান শাহরিয়ার চৌধুরী বলেন, রোয়ানুর প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে ইউনিয়নের ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে চার হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও তিন হাজার আংশিক ভেঙে গেছে। সড়কযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় লোকজনের আয়-রোজগার বন্ধ। তাই শ্রমজীবী মানুষ জন্মভিটা ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যাচ্ছে।
শাহরিয়ার চৌধুরীর দাবি, এ পর্যন্ত তাঁর ইউনিয়ন থেকে এক হাজার পরিবারের অন্তত ছয় হাজার মানুষ অন্যত্র চলে গেছে। আরও অনেকে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোস্ট ট্রাস্টের সমৃদ্ধি প্রকল্পের সমন্বয়কারী ফজলুল হক বলেন, এই ইউনিয়নের ৫৬টি গ্রামে প্রায় দেড় হাজার ক্ষতিগ্রস্ত ভিটেবাড়ি পাওয়া গেছে, যেখানে কেউ নেই।
উপজেলার আলীআকবরডেইল ও কৈয়ারবিল ইউনিয়নেও এ রকম এক হাজার ঘরবাড়ি পড়ে আছে। এসব ঘরবাড়ির অন্তত ১০ হাজার মানুষ ইতিমধ্যে কুতুবদিয়া ছেড়ে গেছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে ভাঙা বেড়িবাঁধ সংস্কার করে জোয়ার ঠেকানো না গেলে উপকূলের কয়েকটি ইউনিয়ন জনশূন্য হয়ে পড়বে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সালেহীন তানভীর গাজী বলেন, উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে ঘূর্ণিঝড়ে খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৩ হাজার ৫০০ জন। এর মধ্যে কিছু লোক কাজের সন্ধানে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন।