ছাড়া মিললেও অবরোধে আটকা

টানা অবরোধে দুর্ভোগ আর বিড়ম্বনার শেষ নেই মানুষের। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েও বাড়ি ফিরতে পারছেন না অনেকেই। কুষ্টিয়ার মো. রিয়াজ বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হওয়ার পর গুরুতর আহত অবস্থায় ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে। মোটামুটি সুস্থ হওয়ার পর গত শনিবার তাঁকে ছাড়পত্র দিয়েছেন চিকিত্সকেরা। কিন্তু বাড়ি ফেরার উপায় নেই। তাই বাধ্য হয়ে এখন হাসপাতালের মেঝেতেই থাকতে হচ্ছে তাঁকে। গতকাল তোলা ছবি ষ হাসান রাজা
টানা অবরোধে দুর্ভোগ আর বিড়ম্বনার শেষ নেই মানুষের। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েও বাড়ি ফিরতে পারছেন না অনেকেই। কুষ্টিয়ার মো. রিয়াজ বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হওয়ার পর গুরুতর আহত অবস্থায় ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে। মোটামুটি সুস্থ হওয়ার পর গত শনিবার তাঁকে ছাড়পত্র দিয়েছেন চিকিত্সকেরা। কিন্তু বাড়ি ফেরার উপায় নেই। তাই বাধ্য হয়ে এখন হাসপাতালের মেঝেতেই থাকতে হচ্ছে তাঁকে। গতকাল তোলা ছবি ষ হাসান রাজা
যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগে গত ১২ নভেম্বর হরতালে বাসে পেট্রলবোমা হামলায় অগ্নিদগ্ধ হন আ. মান্নান। চিকিত্সকের ছাড়পত্র পেয়েছেন গতকাল। হাসপাতালের অন্য রোগীদের কাছ থেকে বিদায় নিলেও নিজের বাড়ি নোয়াখালীতে যেতে পারছেন না তিনি। আপাতত মিরপুরে এক আত্মীয়ের বাসায় ওঠার কথা তাঁর। অবরোধের পর নোয়াখালীতে ফিরে যাবেন ষ ছবি: প্রথম আলো
যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগে গত ১২ নভেম্বর হরতালে বাসে পেট্রলবোমা হামলায় অগ্নিদগ্ধ হন আ. মান্নান। চিকিত্সকের ছাড়পত্র পেয়েছেন গতকাল। হাসপাতালের অন্য রোগীদের কাছ থেকে বিদায় নিলেও নিজের বাড়ি নোয়াখালীতে যেতে পারছেন না তিনি। আপাতত মিরপুরে এক আত্মীয়ের বাসায় ওঠার কথা তাঁর। অবরোধের পর নোয়াখালীতে ফিরে যাবেন ষ ছবি: প্রথম আলো

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের চারতলা। বারান্দার মেঝেতে কাঁথা বিছিয়ে শুয়ে আছেন মো. রিয়াজ। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তিনি অগ্নিদগ্ধ হন। ছাড়পত্র পেয়েছেন গত শনিবার। পরদিন নতুন রোগী না আসায় ‘বিছানা’তেই ছিলেন। কিন্তু রাতে নতুন রোগী আসায় শয্যা ছেড়ে এখন মেঝেতে। ‘ছুটি’ পেলেও অবরোধের কারণে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত মাকে নিয়ে নিজের বাড়ি কুষ্টিয়ায় ফিরতে পারেননি তিনি।

রিয়াজের মতো এমন ১৮ জন গত এক সপ্তাহে বার্ন ইউনিট থেকে ‘ছুটি’ পেলেও অবরোধের কারণে বাড়ি ফিরতে পারছেন না। এঁদের সবার বাড়ি রাজধানীর বাইরে। আত্মীয়স্বজন নিয়ে তাঁরা হাসপাতালের দোতলা ও চারতলার বারান্দায় অবস্থান করছেন। এই ১৮ জনের অন্যদের পাঁচজনের বাড়ি উত্তরবঙ্গে, দুজনের ময়মনসিংহে, তিনজনের নোয়াখালীতে, দুজনের চট্টগ্রামে এবং পাঁচজনের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ধামরাই, শ্রীপুর, আশুলিয়া ও মদনগঞ্জে।

কয়েকজন চিকিৎসক জানান, আগুনে পোড়া রোগীরা হাসপাতাল ছাড়লেও তাঁদের দরকার বাড়তি যত্নের। কেবল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, খাবার-পথ্য নয়, সঙ্গে ত্বক সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থেকেও সতর্ক থাকতে হয়। কিন্তু সময়মতো বাড়ি ফিরতে না পারায় তাঁরা চিকিৎসা-পরবর্তী সেবা পুরোপুরি পাচ্ছেন না।
রিয়াজের বিষয়ে চিকিৎসক হোসাইন বলেন, রিয়াজের বাঁ কনুই অকেজো। ঘা প্রায় শুকালেও সংক্রমণের ঝুঁকি কমেনি।

গত শুক্রবার রাতে ‘ছুটি’ পেয়ে দোতলার বারান্দায় স্থান হয়েছে মমতাজের পরিবারের। বাড়ি নওগাঁয়। চাতালের কাজে হাত পুড়েছিল মমতাজের। এখন ঘা শুকালেও হাত অকেজো। মমতাজের সঙ্গী স্বামী কৃষক রশীদ আলী ও চার বছরের মেয়ে খুশি। খুশির গরম কাপড়ও নেই তেমন। রশীদ বলেন, ‘চাইরদিকে যে অবস্থা, তাতে বাসে চড়লে মেয়ে-বউ লইয়া পুড়ন লাগব। ট্রেন তো উল্টাই ফালায় দিতাছে। অবরোধ ছাড়লে যামুনে।’

পঞ্চাশোর্ধ্ব জোবেদা খানমের ছেলে রফিক গাড়ি মেরামতকারী। বাড়ি নাটোরে। দুর্ঘটনায় পুড়ে গেছে রফিকের পা। শুক্রবার বিকেলে হাসপাতাল থেকে ‘ছুটি’ পেলেও বাড়ি যাওয়ার সাহস পাচ্ছেন না তিনি। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের লোকেরা ভালো। আমাগো এহনো খাওন দেয়। নাইলে কী যে হইত!’

একজন চিকিৎসক বলেন, ‘হাসপাতালের বিনা মূল্যের খাদ্য শুধু রোগীদের জন্য। কিন্তু ডিসচার্জ (ছুটি পাওয়া) হওয়ার পরেও যাঁরা যেতে পারছেন না, তাঁদের তো ফেলে দিতে পারছি না।’

গত ১২ নভেম্বর সারা দেশে ১৮-দলীয় জোটের হরতাল ছিল। ওই দিন যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগে একটি বাসে পেট্রলবোমা হামলায় অগ্নিদগ্ধ হন আটজন। তাঁদের একজন হলেন আ. মান্নান। তাঁর শরীরের ১৯ শতাংশ পুড়েছিল। গতকাল ছুটি পেয়ে যাচ্ছেন মিরপুরে আত্মীয়ের বাসায়। অবরোধের পর নোয়াখালীতে নিজ বাড়িতে যাবেন।

বার্ন ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক সামন্তলাল সেন জানান, সাম্প্রতিক হরতাল ও অবরোধের সহিংসতায় অগ্নিদগ্ধদের মধ্যে আটজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে এখনো ভর্তি ৩৪ জন রোগী।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অন্য চিকিৎসা শেষে ছুটি পেলেও অবরোধের কারণে বাড়ি যেতে পারছে না অনেকেই। জরুরি বিভাগের নিচতলার বারান্দায় মেঝেতে মা জোছনা বেগমের কোলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে জরিনা (৯)। জ্বর ও ঠান্ডা নিয়ে এসেছিল জরিনা। এখন সুস্থ। বাড়ি নোয়াখালী। জোছনা বেগম জানান, দুই দিন ধরে তাঁরা এখানেই রয়েছেন। খাবার বাইরে থেকে কিনে আনছেন। ভয় পাচ্ছেন মেঝে থেকে ওঠা ঠান্ডায় মেয়ে না আবার অসুস্থ হয়।

হাসপাতালের অনুসন্ধান বিভাগ থেকে জানা গেছে, গত শনিবার দুপুর থেকে গতকাল বেলা দুইটা পর্যন্ত ৫৩ জন রোগী সুস্থ হওয়ায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এদের মধ্যে কতজন হাসপাতাল ছেড়েছে তা জানে না অনুসন্ধান বিভাগ। বার্ন ইউনিটের রোগীকে ‘ছুটি’ দেওয়ার পরে তাদের কয়জন আছে বা কয়জন হাসপাতাল ছেড়েছে, সেই তথ্য দিতে পারেনি।