নাইকো দুর্নীতি : খালেদাসহ ২৬ জনের নাম আন্তর্জাতিক আদালতে

খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি
খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি

দুর্নীতির মাধ্যমে নাইকোর সঙ্গে বাপেক্সের চুক্তি সম্পাদনপ্রক্রিয়ায় জড়িত হিসেবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদসহ ২৬ জনের নাম আন্তর্জাতিক আদালতে (ইকসিড) উপস্থাপন করা হয়েছে।
দেশেও খালেদা জিয়ারসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের করা নাইকো দুর্নীতির একটি মামলা চলমান রয়েছে।
বিনিয়োগ বিরোধ নিষ্পত্তি–সংক্রান্ত এই আন্তর্জাতিক নালিশি আদালতের চাহিদা ও নির্দেশনা অনুযায়ী গত ১৪ জুন পাঠানো এ তালিকায় সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব কামাল সিদ্দিকী এবং সাবেক জ্বালানিসচিব খন্দকার শহীদুল ইসলামের নামও রয়েছে। তালিকাভুক্ত অন্য সবাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জ্বালানি মন্ত্রণালয়, পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের সাবেক কর্মকর্তা।
এ ছাড়া নাইকোর কাছ থেকে গ্যাস কেনার চুক্তি-প্রক্রিয়ায় জড়িত হিসেবে আরও ২৭ জনের নামের অপর একটি তালিকা পাঠানো হয়েছে। এই তালিকায় নাইকো রিসোর্সেস (বাংলাদেশ) লিমিটেডের প্রেসিডেন্ট কাশেম শরিফ, ভাইস প্রেসিডেন্ট পিটার জে মার্সিয়ের, ব্রায়ান জে অ্যাডলফ, জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক অমিত গয়াল ও সৈয়দ আর কবির ছাড়া সবাই জ্বালানি মন্ত্রণালয়, পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের শীর্ষস্থানীয় সাবেক কর্মকর্তা।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র প্রথম আলোকে বলেন, তালিকায় যেসব কর্মকর্তার নাম রয়েছে, তাঁদের সরকারি দায়িত্বের অংশ হিসেবে এ ধরনের যেকোনো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়। তাই দুর্নীতির সঙ্গে তাঁদের কে কতটা জড়িত, তা নিশ্চিত নয়। তবে ২০০১-০৫ মেয়াদের সরকারের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও সরকারের রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা এই দুর্নীতিতে যুক্ত ছিলেন। এর প্রমাণযোগ্য তথ্যও সরকারের কাছে রয়েছে।

নাইকোর বিরুদ্ধে বাপেক্স তথা সরকার গত ২৫ মার্চ ইকসিডে দুর্নীতির যে অভিযোগ দাখিল করেছিল, সে বিষয়ে আরও তথ্য চেয়ে ২৬ মে ওই আদালত একটি আদেশ (প্রেসিডিওরাল অর্ডার) জারি করেন। তাতে নাইকোর দুর্নীতির আরও তথ্য থাকলে সেগুলো এবং নাইকো-বাপেক্স যৌথ উদ্যোগ (জেভিএ) ও গ্যাস ক্রয় চুক্তি সম্পাদনপ্রক্রিয়ায় যাঁরা যুক্ত ছিলেন, তাঁদের নামের তালিকা ১৪ জুনের মধ্যে উপস্থাপন করতে বলা হয়েছিল। সে অনুযায়ী এই তালিকা ও দুর্নীতির আরও কিছু তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।
সূত্র বলেন, নাইকোর দুর্নীতি ও তার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের যেসব তথ্য ইকসিডে পাঠানো হয়েছে, তা মূলত সরকারি নথিভিত্তিক। এর সঙ্গে কিছু তথ্য রয়েছে রয়েল কানাডীয় মাউন্টেড পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে পাওয়া। সরকারি নথিতে পাওয়া তথ্যে স্পষ্ট বোঝা যায়, দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারের অবস্থান কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। কীভাবে ছাতক (পূর্ব) গ্যাসক্ষেত্রটি প্রান্তিক দেখিয়ে নাইকোর কাছে ইজারা দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, নাইকোর সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন যে দুর্নীতির মাধ্যমে হয়েছে, তথ্য-প্রমাণে তা ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট হচ্ছে। সরকার নাইকোর দুর্নীতির আরও তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছে।

নথিপত্র কী বলে : সরকারি সূত্রগুলো বলেন, সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে নাইকো ছাতক গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নের জন্য একটি অযাচিত (আনসলিসিটেড) প্রস্তাব দেয় ১৯৯৮ সালে। জ্বালানি মন্ত্রণালয় প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করে তিনটি নির্দেশনা দেয়। এক, প্রান্তিক গ্যাসক্ষেত্র (যে ক্ষেত্র থেকে গ্যাস তোলা শেষ অর্থাৎ পরিত্যক্ত ক্ষেত্র) উন্নয়নের প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য। দুই, এ ব্যাপারে বাপেক্স নাইকোর সঙ্গে সমঝোতার বিষয়ে আলোচনা করতে পারে। তিন, এই প্রক্রিয়ায় কোনো গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নের প্রস্তাবকে ‘সুইস চ্যালেঞ্জ’-এর মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
সুইস চ্যালেঞ্জের অর্থ হলো—নাইকো-বাপেক্স যৌথ সমীক্ষা ও সমঝোতার ভিত্তিতে প্রান্তিক গ্যাসক্ষেত্র নির্ধারণ করবে। এর ভিত্তিতে নাইকো উক্ত গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নের যে প্রস্তাব দেবে, তার ওপর উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হবে। সেই দরপত্রে যদি অন্য কোনো কোম্পানি নাইকোর চেয়ে আকর্ষণীয় প্রস্তাব দেয়, তাহলে সেই প্রস্তাব গৃহীত হবে। সে ক্ষেত্রে নাইকো গ্যাসক্ষেত্রের ইজারা পাবে না।
এই নির্দেশনা অনুযায়ী ১৯৯৯ সালের আগস্টে নাইকো-বাপেক্স প্রান্তিক গ্যাসক্ষেত্র নির্ধারণের জন্য একটি যৌথ সমীক্ষা করে। এই সমীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে যৌথ উদ্যোগের কোম্পানি (জেভিএ) গঠনের জন্য কোম্পানি দুটির মধ্যে আলোচনার সময় ছাতককে (পূর্ব) প্রান্তিক গ্যাসক্ষেত্র বলে মানতে বাপেক্স অস্বীকার করে।
২০০১ সালের ২৬ জুন বাপেক্স নথিতে উল্লেখ করে যে ছাতক (পূর্ব) ক্ষেত্রটি প্রান্তিক হিসেবে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, ক্ষেত্রটিতে কোনো কূপই খনন করা হয়নি। বরং কূপ খনন কর্মসূচির মধ্যে ক্ষেত্রটির নাম রয়েছে। কাজেই যে ক্ষেত্র থেকে কখনো গ্যাসই তোলা হয়নি, তা কোনোভাবেই প্রান্তিক ক্ষেত্র হতে পারে না।
নথিতে এই মতামত আসার কয়েক দিন পরই তৎকালীন সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর নতুন সরকার ক্ষমতাসীন হয়। এরপরও কিছুদিন বিষয়টি নিয়ে কোনো দৃশ্যমান তৎপরতা ছিল না। এরপর হঠাৎ ২০০৩ সালের ১৬ অক্টোবর নাইকো-বাপেক্স জেভিএ সই হয়। এর আগে, ওই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদের আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘মওদুদ আহমদ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’ ছাতক পূর্ব ও পশ্চিমকে অভিন্ন ক্ষেত্র দেখিয়ে প্রান্তিক বলা যায় বলে সরকারকে পরামর্শ দেয়। এরপর আইন মন্ত্রণালয় পূর্ববর্তী সরকারের ‘সুইস চ্যালেঞ্জ’-এর বিধান রদ করে।
এরপর কূপ খনন করতে গিয়ে নাইকো ২০০৫ সালে ছাতক ক্ষেত্রে দুবার বিস্ফোরণ ঘটায়। প্রথম ৭ জানুয়ারি, দ্বিতীয়বার ২৪ জুন। নাইকোর অদক্ষ খননপ্রক্রিয়াই ছিল ওই দুর্ঘটনার কারণ। দেশে ওই বিস্ফোরণের ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবি ওঠে।
ইতিমধ্যে তৎকালীন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেনকে ১ লাখ ৯০ হাজার কানাডীয় ডলার দামের একটি গাড়ি ও বিদেশ সফরের জন্য পাঁচ হাজার ডলার ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে নাইকোর বিরুদ্ধে। ২০০৬ সালে রয়েল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ বাংলাদেশে এই অভিযোগের তদন্ত শুরু করে। ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নাইকো ছাতক গ্যাসক্ষেত্রের কাজ পাওয়ার জন্য একজন মধ্যস্থতাকারীকে (লবিস্ট) ১০ লাখ ডলার ঘুষ দিতে সম্মত হয়েছিল এবং কিছু টাকার লেনদেনও হয়েছিল।
ওই প্রতিবেদনের সূত্র ধরে ১ কোটি ৮ লাখ টাকার একটি লেনদেনের (চেকের মাধ্যমে) ঘটনা উদ্‌ঘাটিত হয়। জেভিএ সই হওয়ার পর, ২০০৪ সালের ৮ জানুয়ারি এই লেনদেন হয় স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের মাধমে। বাংলাদেশে কানাডীয় পুলিশ তদন্ত করে ঘুষের অর্থ লেনদেনের একটি সময়সূচি জানতে পেরেছিল। এর মধ্যে একটি লেনদেনের সময় ছিল জেভিএ চুক্তির পর। এই ১ কোটি ৮ লাখ টাকা সেই লেনদেনেরই অংশ বলে পারিপার্শ্বিক অন্যান্য তথ্য মিলিয়ে নিশ্চিত হয়েছেন সরকারপক্ষের আইনজীবীরা। যাঁদের মধ্যে এই লেনদেন হয়েছে, তাঁরা নাইকো-বাপেক্স চুক্তির বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত ছিলেন। কানাডীয় পুলিশের কাছে এ ব্যাপারে তাঁরা সাক্ষ্য ও তথ্য দিয়েছেন।
কানাডার আদালতে নাইকো এসব ঘুষ-দুর্নীতির কথা স্বীকার করেছে। দোষ স্বীকার করায় কানাডার আইন অনুযায়ী আদালত নাইকোকে লঘু দণ্ড দেয়। কিন্তু কানাডার পুলিশের কাছে নাইকোর কৃতকর্মের সব তথ্যই রয়ে যায়। সরকারের নিযুক্ত আইনজীবীরা সেই তথ্য সংগ্রহ করে তার ভিত্তিতে গত ২৫ মার্চ বাপেক্সের পক্ষ থেকে ইকসিডে নাইকোর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করে।
একইসঙ্গে টেংরাটিলায় দুই দফা বিস্ফোরণের দায়ে নাইকোর কাছে প্রায় ৯ হাজার ২৫০ কোটি টাকা (প্রায় ১১৭ কোটি মার্কিন ডলার) ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়। এই প্রেক্ষাপটে ইকসিড নাইকোর করা মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে নাইকোর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এখন সেই প্রক্রিয়া চলছে। তার অংশ হিসেবেই দুর্নীতির আরও অভিযোগ এবং নাইকো-বাপেক্স জেভিএ ও গ্যাস কেনার চুক্তির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের তালিকা দেওয়া হয়েছে।
এর পরবর্তী কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে সরকারপক্ষের অন্যতম আইনজীবী মঈন গনি প্রথম আলোকে বলেন, শিগগিরই ইকসিডের বিচারকেরা মামলার পক্ষগুলোর সঙ্গে একটি টেলিকনফারেন্স করবেন। তখন দুর্নীতির নতুন তথ্যাদি ও জড়িত ব্যক্তিদের তালিকা সম্পর্কে আলোচনা হবে। তা ছাড়া শুনানির একটি তারিখও তখন নির্ধারিত হবে।

গ্যাসের দাম এখনই নয়

ফেনী ক্ষেত্র থেকে সরবরাহ করা নাইকোর গ্যাসের দাম পরিশোধ করার জন্য ইকসিড প্রথম আদেশ (প্রোসিডিওরাল অর্ডার, অ্যাওয়ার্ড বা রায় নয়) দেন ২০১৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। পেট্রোবাংলা তখন আদালতকে অনুরোধ করে নাইকোর সব দায়দায়িত্ব নিরূপণের পর দাম পরিশোধের সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্য।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ইকসিডের দেওয়া দ্বিতীয় আদেশে বলা হয়, গ্যাসের দাম বাবদ নাইকোর পাওনা টাকা তৃতীয় কোনো হিসাবে (এসক্রো অ্যাকাউন্ট) জমা রাখতে। কিন্তু হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকায় পেট্রোবাংলা তা করেনি।
এই প্রেক্ষাপটে গত ২৬ মে দেওয়া আদেশে ইকসিড পেট্রোবাংলাকে বলেছে নাইকোর পাওনা পরিশোধ করে দিতে। এ ব্যাপারে অন্য কোনো আদালতের আদেশ কার্যকর হবে না বলেও ইকসিডের আদেশে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এটি ইকসিডের অ্যাওয়ার্ড বা চূড়ান্ত রায় নয়। ইকসিড গ্যাসের দাম পরিশোধ-সংক্রান্ত নাইকোর মামলা এখনো নিষ্পত্তি করেনি। যদিও নাইকো এ ব্যাপারে অ্যাওয়ার্ড চেয়েছিল। কিন্তু ইকসিড তা দেয়নি। এই অবস্থায় নাইকোর গ্যাসের দাম এখনই পরিশোধ করা পেট্রোবাংলার জন্য বাধ্যতামূলক নয়।
উপরন্তু, ১২ মে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলমের করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট যে আদেশ দিয়েছেন, তাতে ৯ নম্বর ব্লকের বাঙ্গুরা ক্ষেত্র থেকে নাইকো যে গ্যাস সরবরাহ করছে, তার দামও রিট নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত পরিশোধ করা যাবে না।
তবে নাইকো যে গ্যাসের দাম পাবে, তা পেট্রোবাংলাও ইকসিডে স্বীকার করেছে। টেংরাটিলায় বিস্ফোরণের ক্ষতিপূরণ-সংক্রান্ত মামলা নিস্পত্তি হলে তার সমন্বয় করে এই দাম পরিশোধ করা হবে।