নৌকা না পেলে ক্লাস 'মিস'

>
শ্রাবণের আকাশে ঘন কালো মেঘ। টিপটিপ বৃষ্টিও পড়ছে। এর মধ্যে নৌকায় করে হাওর পাড়ি দিচ্ছে কয়েকজন শিক্ষার্থী। বিদ্যালয় ছুটির পর বাড়ি ফিরছে তারা। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের মাটিয়ান হাওর থেকে তোলা ছবি l প্রথম আলো
শ্রাবণের আকাশে ঘন কালো মেঘ। টিপটিপ বৃষ্টিও পড়ছে। এর মধ্যে নৌকায় করে হাওর পাড়ি দিচ্ছে কয়েকজন শিক্ষার্থী। বিদ্যালয় ছুটির পর বাড়ি ফিরছে তারা। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের মাটিয়ান হাওর থেকে তোলা ছবি l প্রথম আলো
সরকারি ব্যবস্থাপনায় ইঞ্জিনচালিত বড় নৌকার ব্যবস্থা না থাকায় ছোট ছোট নৌকায় করে প্রতিদিনই ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হয় শিক্ষার্থীরা

বৃহস্পতিবার বেলা দেড়টা। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। এর মধ্যেই সুনামগঞ্জের দুর্গম এলাকা তাহিরপুরের সূর্যেরগাঁও ঘাটে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকজন ছাত্রছাত্রী। ছাতা মাথায় কেউ কেউ ছোট কয়েকটি নৌকায় বসা, কেউ আবার বৃষ্টি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পাশের ছোট দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের একজন বিজয় আহমেদ, তাহিরপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। বাড়ি দেড়-দুই কিলোমিটার দূরে গাজীপুর গ্রামে। বাড়ি যাওয়ার জন্য আরও কয়েকজনের সঙ্গে সেও অপেক্ষায় আছে নৌকা কখন ছাড়বে। সে বলল, ভাড়া করা (রিজার্ভ) নৌকা দিয়ে তাদের গ্রামের ২০-২৫ জন ছাত্রছাত্রী প্রতিদিন যাওয়া-আসা করে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ে তারা। কিন্তু সবাই ঘাটে না এলে নৌকা ছাড়বে না। এ জন্য বাড়ি যাওয়ার সময় ঠিক থাকে না। তবে সকালে স্কুলে আসার জন্য সকাল ৮টায় নৌকা ছাড়ে। কিন্তু তখন কোনো কারণে নৌকা ধরতে না পারলে কিংবা নৌকা না গেলে স্কুলে যাওয়া হয় না। যাওয়া-আসা বাবদ প্রতিদিন একেকজনকে ১৫ টাকা করে দিতে হয়।

তাহিরপুরের আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের শত শত শিক্ষার্থীকে বর্ষাকালে পড়াশোনার জন্য এভাবেই নৌকার ওপর নির্ভর করতে হয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা বলেন, সরকারি ব্যবস্থাপনায় ইঞ্জিনচালিত বড় নৌকার ব্যবস্থা না থাকায় ছোট ছোট নৌকায় করে প্রতিদিনই ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হয় শিক্ষার্থীরা। এখন বর্ষাকালে গ্রামের সামনের ও পেছনের বিলগুলো ভরে গিয়ে দেখতে বিশাল নদীর আকার নিয়েছে। গ্রামগুলোর অবস্থা দ্বীপের মতো। এ কারণে নৌকা ছাড়া চলাচলের কোনো উপায় নেই।
বদরুল নামে এক মাঝি বলেন, তাঁরা কয়েকজন আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের শিক্ষার্থীদের পারাপার করান। কিন্তু আবহাওয়া খারাপ থাকলে ঝুঁকি বাড়ে। তিন-চার মাস এভাবেই কষ্ট করে চলাচল করে শিক্ষার্থীরা।
উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, তাহিরপুর উপজেলায় গ্রাম ২৪৯টি। এর মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ১৩৩টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৪টি, দুটি স্কুল কলেজ পর্যায় পর্যন্ত ও কলেজ চারটি। গ্রামগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে দূরে হওয়ায় বর্ষাকালে ঝুঁকি আর সমস্যা নিয়েই যাতায়াত করতে হয় শিক্ষার্থীদের। তাহিরপুর ছাড়াও জামালগঞ্জ, বিশ্বম্ভরপুর, ধরমপাশা, দিরাই, শাল্লাসহ বিভিন্ন উপজেলার হাজারো শিক্ষার্থীকে বর্ষাকালে এভাবে সংগ্রাম করে পড়াশোনা করতে হয়। এসব এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকেরাও থাকতে চান না। সরকারি স্কুলের শিক্ষকেরা তদবির করে বদলি হয়ে সুবিধামতো স্কুলে চলে যান। এ কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনাও ঠিকমতো হয় না।
শিক্ষার্থীরা কতটা ঝুঁকি নিয়ে স্কুল-কলেজে যাতায়াত করে তা দেখা গেল তাদেরই একটি নৌকায় চড়ে। ছোট এসব নৌকায় উঠলে যে-কারও ভয় হবে। সামান্য বাতাসে ঢেউ উঠলেই ঝুঁকি বাড়ে। আবার বৃষ্টি নামলে বইপত্র ভিজে যায়। নৌকাতেই দেখা গেল, এক ছাত্রীর হাতে থাকা খাতা ও কাগজপত্র ভিজে একাকার। এত বৃষ্টি যে ছাতা দিয়েও রক্ষা হয়নি। তার সঙ্গে ছিল কলেজপড়ুয়া বড় বোন। বড় বোন বৃষ্টি বেগম বলেন, প্রতিদিনই এভাবে ‘যুদ্ধ’ করে ক্লাসে আসতে হয়। কোনো কারণে নৌকা ধরতে না পারলেই ক্লাস ‘মিস’ হয়। গত বৃহস্পতিবার সকালেই নৌকা যেতে দেরি হওয়ায় সকালের প্রাইভেট মিস করেছেন।
উপজেলা থেকে নৌকায় করে জামলাবাজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল, পাকা খুঁটির ওপর তৈরি ভবনের নিচে ও চতুর্দিকে পানি। স্কুলে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী মিনহা বলে, তারা নৌকায় করেই আসা-যাওয়া করে। একজন সহকারী শিক্ষক বলেন, এখন পানির সঙ্গে স্রোতও আছে। এ রকম পরিস্থিতিতে ছোট ছোট শিশুদের যাওয়াটা সত্যিই কষ্টকর। রতনশ্রী পূর্ব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়েও একই চিত্র দেখা গেল। সংস্কারের অভাবে স্কুলটির এখন করুণ হাল। শাহিন আলম নামে পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্র বলে, বর্ষাকাল তাই উপস্থিতি কমে গেছে।
এর আগে বিশ্বম্ভরপুরে দেখা গেছে অসংখ্য শিক্ষার্থী নৌকায় চড়ে যাচ্ছে। আবার কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোমরপানি পেরিয়ে ছাত্রছাত্রীদের চলাচল করতে দেখা গেছে।
এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে কয়েকজন শিক্ষক ও অভিভাবক প্রথম আলোকে বলেন, এখানে পানি একটি বাস্তবতা। এসব এলাকায় রাতারাতি রাস্তাঘাট করা সম্ভব হবে না। আবার প্রতি গ্রামে স্কুল-কলেজ করাও সম্ভব না। এ জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় সময় ধরে ইঞ্জিনচালিত বড় নৌকার ব্যবস্থা করতে পারলে শিক্ষার্থীদের কষ্ট ও খরচ কমত।
এ বিষয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ খালেদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এখানে একটি কথা প্রচলন আছে ‘বর্ষায় নাও, হেমন্তে পাও (পা)’। এ রকম বাস্তবতায় সরকারিভাবে বড় নৌকা দিলে সেটা ব্যবস্থাপনা করাটা কঠিন। তারপর কোনো এলাকার মানুষ যদি দাবি নিয়ে আসে তাহলে সম্ভাবনা যাচাই করে উদ্যোগ নেওয়া হবে।