ত্রাণের অভাবে দুর্গত মানুষ

বন্যার পানিতে থই থই গ্রামের রাস্তাঘাট ও চারপাশ। বাধ্য হয়ে ভেলায় চড়ে স্কুলে যাচ্ছে চার শিশু। ছবিটি গতকাল সকালে ফরিদপুর সদর উপজেলার ডিক্রির চর ইউনিয়নের আইজদ্দিন মাতুব্বরেরডাঙ্গি এলাকা থেকে তুলেছেন আলীমুজ্জামান
বন্যার পানিতে থই থই গ্রামের রাস্তাঘাট ও চারপাশ। বাধ্য হয়ে ভেলায় চড়ে স্কুলে যাচ্ছে চার শিশু। ছবিটি গতকাল সকালে ফরিদপুর সদর উপজেলার ডিক্রির চর ইউনিয়নের আইজদ্দিন মাতুব্বরেরডাঙ্গি এলাকা থেকে তুলেছেন আলীমুজ্জামান

ফরিদপুর, রাজবাড়ী, শেরপুর ও গাইবান্ধায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পানি উঠেছে নতুন নতুন এলাকায়। তবে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, কুড়িগ্রাম ও টাঙ্গাইলে। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে কেবল বগুড়ায়। তবে সব জায়গাতেই ত্রাণের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে বানভাসি মানুষেরা।
পদ্মার পানি বাড়া অব্যাহত রয়েছে। ফাটল ধরেছে ফরিদপুর শহররক্ষা বাঁধে। সদর উপজেলার ডিক্রির চর, নর্থ চ্যানেল এবং আলিয়াবাদ ইউনিয়নের বিপুলসংখ্যক মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন গতকাল ডিক্রির চর ও নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নের ৮৫০টি পরিবারের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেন। তবে সদরের আলিয়াবাদ ও চরমাধবদিয়া ইউনিয়নে গতকাল পর্যন্ত বন্যাদুর্গত লোকজনকে কোনো সাহায্য দেওয়া হয়নি। চরভদ্রাসনের চরহরিরামপুর ইউনিয়নের পূর্ব শালেপুর গ্রামে গতকাল দুপুরে পানিতে ডুবে আলী বেপারী (৮৫) নামের এক ব্যক্তি মারা গেছেন বলে জানা গেছে।

.
.

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) রাজবাড়ী কার্যালয়ের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী নুরুল নবী গতকাল জানান, পদ্মার পানি বাড়ায় জেলার সদর, কালুখালী, পাংশা এবং গোয়ালন্দ উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, দুর্গত ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণের জন্য তাঁরা ত্রাণ পাননি। তাঁরা ত্রাণের জন্য সহায়তা কামনা করছেন। গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পঙ্কজ ঘোষ জানান, তাঁর উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য শনিবার আরও ৭৫ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করা হয়েছে।
ব্রহ্মপুত্র নদ ও দশআনী নদীর পানি বাড়া অব্যাহত থাকায় শেরপুর সদর উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নের ৪০টি গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। জেলা প্রশাসক এ এম পারভেজ রহিম বলেন, আজ (রোববার) বিকেলে বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করে ত্রাণ সহায়তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
গাইবান্ধা সদর উপজেলার বোয়ালি ইউনিয়নের তালুক বুড়াইল এলাকায় গতকাল দুপুরে সোনাইল বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের প্রায় ৩০০ ফুট অংশ ভেঙে কমপক্ষে আটটি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। তালুক বুড়াইল গ্রামের কৃষক খোকা মিয়া (৫০) বলেন, ‘কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আমার তিনটি ঘর, আসবাবপত্র, গোলার ধান-চাল ডুবে গেছে। গবাদিপশু নিয়ে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছি।’
শনিবার রাতে একই উপজেলার খামার বোয়ালি এলাকায় গাইবান্ধা-কালীরবাজার সড়কের আধা কিলোমিটার অংশ ডুবে যাওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে গাইবান্ধা-সাঘাটা সড়ক। গাইবান্ধার চারটি উপজেলার ৩৩টি ইউনিয়নে পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার মানুষ। সিরাজগঞ্জে যমুনার পানি কিছুটা কমলেও জেলায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। শাখা নদীগুলোতে পানি বাড়া অব্যাহত রয়েছে। করতোয়া, বড়াল, হুরাসাগর, ধলাই এবং ফলঝোর নদের পানি বাড়ার কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলো প্লাবিত হয়েছে। তাঁতসমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে পরিচিত শাহজাদপুর, বেলকুচি ও এনায়েতপুরের হাজার হাজার তাঁত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন এসব কারখানার শ্রমিকেরা।

বগুড়ার সারিয়াকান্দির চন্দনবাইশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনটি আগেই বিলীন হয়েছে যমুনায়। পাঠদান অব্যাহত রাখতে স্থানীয় ঘুঘুমারী এলাকায় একটি বাঁধের কাছে কোনো রকমে তোলা হয়েছে টিনের চালা। সেখানেও উঠেছিল বন্যার পানি। পানি সরে গিয়ে এখন শ্রেণিকক্ষে থকথকে কাদা। এর মধ্যে ক্লাস করছে শিশুরা। গতকাল দুপুরে ছবিটি তোলেন সোয়েল রানা
বগুড়ার সারিয়াকান্দির চন্দনবাইশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনটি আগেই বিলীন হয়েছে যমুনায়। পাঠদান অব্যাহত রাখতে স্থানীয় ঘুঘুমারী এলাকায় একটি বাঁধের কাছে কোনো রকমে তোলা হয়েছে টিনের চালা। সেখানেও উঠেছিল বন্যার পানি। পানি সরে গিয়ে এখন শ্রেণিকক্ষে থকথকে কাদা। এর মধ্যে ক্লাস করছে শিশুরা। গতকাল দুপুরে ছবিটি তোলেন সোয়েল রানা

জামালপুরের বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। রেললাইনে বন্যার পানি ওঠায় জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জ রেলপথে শনিবার সকাল থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে ওই রেলপথের যাত্রীরা চরম বিপাকে পড়েছে। মেলান্দহ উপজেলার দুরমুঠ এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে রেললাইনের ওপর দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হওয়ায় এই পথে রেল চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।
জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকালে মাদারগঞ্জ উপজেলার দাঁতভাঙ্গা সেতুর অ্যাপ্রোচ সড়ক ভেঙে যাওয়ায় উপজেলার সঙ্গে জেলা শহরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। দুপুরে ইসলামপুর উপজেলার চরপুটিমারী গ্রামে বন্যার পানিতে ডুবে গতকাল দুপুরে মনোয়ারা বেগম (৫৫) ও একই ইউনিয়নের বেনুয়ার চর নয়াপাড়া গ্রামের মরিয়ম বেগম (৫৩) নামের দুই নারীর মৃত্যু হয়েছে।
নদ-নদীর পানি সামান্য কমলেও কুড়িগ্রামের নয় উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ত্রাণের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ মানুষ। গতকাল সকালে চিলমারীর সরকার পাড়া গ্রামের মৃত কফিল উদ্দিনের ছেলে ওসমান হোসেন (৫৫) এবং দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে চিলমারী ডিিগ্র কলেজ মাঠসংলগ্ন এলাকায় পানিতে ডুবে মো. শাহিন মিঞার ছেলে নাজিম মিঞা (১৪) মারা গেছে।
টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। উপজেলার সব কটি ইউনিয়নই বন্যাকবলিত। পানিবন্দী রয়েছে প্রায় ২৫ হাজার পরিবার। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মাঝে গতকাল পর্যন্ত কোনো ত্রাণসামগ্রী পৌঁছায়নি বলে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
যমুনার পানি কমায় বগুড়ায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। সরকারি হিসাবে গতকাল পর্যন্ত সারিয়াকান্দি, সোনাতলা এবং ধুনট উপজেলার ১ লাখ ২১ হাজার মানুষ পানিবন্দী ছিল।

বাড়িঘর তো ডুবছেই, গ্রামের রাস্তার ওপরও গলাসমান পানি। সেই পানি ভেঙে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যাচ্ছেন আবদুস সালাম-জোসনা বেগম দম্পতি। কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার দরিয়ারপার এলাকা থেকে গতকাল সকালে ছবিটি তুলেছেন মঈনুল ইসলাম
বাড়িঘর তো ডুবছেই, গ্রামের রাস্তার ওপরও গলাসমান পানি। সেই পানি ভেঙে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যাচ্ছেন আবদুস সালাম-জোসনা বেগম দম্পতি। কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার দরিয়ারপার এলাকা থেকে গতকাল সকালে ছবিটি তুলেছেন মঈনুল ইসলাম


{প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, শেরপুর, জামালপুর, টাঙ্গাইল, বগুড়া, রাজবাড়ী ও গোয়ালন্দ প্রতিনিধি এবং কুড়িগ্রাম ও ফরিদপুর অফিস}