সরকারি কারখানার অবাধ দূষণ

রাঙামাটির চন্দ্রঘোনা এলাকায় কর্ণফুলী নদীতে ভাসছে সাদা ফেনা। নদীর যে অংশে ফেনা ভাসছে, তার পাশেই কর্ণফুলী পেপার মিলস লিমিটেড। এই কাগজ কারখানা থেকে অপরিশোধিত তরল বর্জ্য সরাসরি মিশছে নদীতে। ছবিটি গতকাল দুপুরে তোলা l প্রথম আলো
রাঙামাটির চন্দ্রঘোনা এলাকায় কর্ণফুলী নদীতে ভাসছে সাদা ফেনা। নদীর যে অংশে ফেনা ভাসছে, তার পাশেই কর্ণফুলী পেপার মিলস লিমিটেড। এই কাগজ কারখানা থেকে অপরিশোধিত তরল বর্জ্য সরাসরি মিশছে নদীতে। ছবিটি গতকাল দুপুরে তোলা l প্রথম আলো

নরসিংদী সদর থেকে পলাশ উপজেলা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার পথ। পথের দুই ধারে ঘন সবুজ। ফুলের নামে নাম এই পলাশ উপজেলার। কিন্তু নরসিংদী শহর থেকে যতই এগোনো যায় পলাশের দিকে, তত বেশি ফিকে হতে থাকে সবুজ।

পলাশ উপজেলা সদরের বাসিন্দা ফরিদা বেগম বললেন, ‘এলাকায় যতটুকু সবুজ গাছপালা দেখতাছেন, সেইটা পাঁচ মাস ধইরা দুইটা সার কারখানা বন্ধ থাকার কারণে। কারখানা যখন চালু থাকে, তখন সেইখান থাইকা সকাল-বিকাল পচা গ্যাস বাইর হয়। আর তহন বাড়ি ছাইড়া যাওয়ার মতন অবস্থা। একটা গাছগাছালিও লাগান যায় না। মইরা যায়। হাঁস-মুরগি কিছুই পালন করা যায় না।’
আগামী নভেম্বরে সারা দেশের কৃষকেরা বোরো ধান লাগানো শুরু করবেন। ধান রোপণের মৌসুমে ইউরিয়ার প্রায় দুই হাজার মেট্রিক টন জোগান দিতে চালু হয়ে যাবে ঘোড়াশাল আর পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা। চার-পাঁচ মাসের ঘুম থেকে জেগে উঠবে এই দুটি সার কারখানা, যাদের অবস্থান খুব কাছাকাছি। দুটি কারখানার কোনোটিতেই নেই বর্জ্য পরিশোধন ও দূষণ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা। কারখানা দুটি থেকে সরাসরি দূষিত অ্যামোনিয়া গ্যাস ও অন্যান্য বর্জ্য ফেলা হয়। আগে এসব ফেলা হতো শীতলক্ষ্যা নদীতে। এখন তা এলাকার খাল-বিলে নিয়ে ফেলা হচ্ছে।
এই চিত্র শুধু পলাশের নয়। শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প করপোরেশনের (বিসিআইসি) ১৪টি কলকারখানার ১০টিতেই নেই দূষণ নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা। সাতটিতে নেই কোনো বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি)। আর পাঁচটি কারখানার কোনো পরিবেশ ছাড়পত্রই নেই। গত মে মাসে পরিবেশ অধিদপ্তরের তৈরি করা প্রতিবেদনে এসব তথ্যের উল্লেখ রয়েছে।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী, লাল তালিকাভুক্ত বা মারাত্মকভাবে দূষণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো স্থাপনের জন্য প্রথমে অবস্থানগত ছাড়পত্র, তারপর পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) করে অনুমোদন নিতে হয়। প্রস্তাবিত কারখানাতে দূষণনিয়ন্ত্রণের জন্য বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) স্থাপনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হয়। কারখানায় দুর্ঘটনাসহ অন্যান্য কারণে পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দিলে তা নিয়ন্ত্রণে কী ব্যবস্থা আছে, তা-ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে জানাতে হয়। এই সবকিছু নিশ্চিত হলে পরিবেশ অধিদপ্তর ইআইএ অনুমোদন দেয়। আর কারখানা স্থাপনের পর শর্ত অনুযায়ী সবকিছু নির্মিত হয়েছে, এটা নিশ্চিত হতে পারলে তবেই মেলে পরিবেশ ছাড়পত্র।

>*বিসিআইসির ১৪ কারখানার ১০টিতে দূষণ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই
* সাতটিতে নেই কোনো বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি)
* পাঁচটি কারখানার কোনো পরিবেশ ছাড়পত্রই নেই

এসব শর্ত না মানলে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পরিবেশ অধিদপ্তর কারখানার মালিককে গ্রেপ্তার, জরিমানা ও জেল দিতে পারে। গত এক বছরে পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট বিভাগ দূষণের অপরাধে প্রায় ৩০০টি শিল্প-কারখানাকে জরিমানাসহ নানা ধরনের শাস্তি দিয়েছে। জরিমানা করা হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা। কিন্তু এই অভিযানের মধ্যে বেশির ভাগই বেসরকারি খাতের শিল্পপ্রতিষ্ঠান। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দূষণ সব সময়ই পরিবেশ আইনের প্রয়োগের বাইরে রাখা হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রাসায়নিক কারখানাগুলোর এসব দূষণ ও পরিবেশ আইনের লঙ্ঘন নিয়ে গত জুনে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়েছিল। সেখানে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি থেকে কারখানাগুলোকে দ্রুত ছাড়পত্র নেওয়া ও দূষণনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য বলা হয়েছিল। এর মধ্যে শুধু কর্ণফুলী পেপার মিলস দূষণনিয়ন্ত্রণে অস্থায়ী ব্যবস্থা নিলেও বাকিগুলো এখনো আগের মতো দূষণ করে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিবেশ আইন লঙ্ঘন ও দূষণকারী কারখানাগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এমন কথা আমাকে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছে। বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেব।’
বিসিআইসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, তাদের কারখানাগুলোতে ইটিপি স্থাপন ও দূষণ রোধে ব্যবস্থা নিতে তিনি একটি কমিটি করে দিয়েছেন। ওই কমিটি বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে।
জরিমানা হলেও মাফ হয়ে যায়: বিসিআইসির প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ২০১০ সালের ৪ নভেম্বর উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি লিমিটেডকে সাড়ে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। পরে আপিলের মাধ্যমে কমিয়ে তা পাঁচ লাখ টাকা করা হয়। পাহাড় কাটার অভিযোগে ২০১৩ সালে সিলেটের ছাতক সিমেন্ট কোম্পানিকে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ২৯ নভেম্বর কর্ণফুলী পেপার মিলস লিমিটেডকে কর্ণফুলী নদী দূষণের অপরাধে ১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। পরে তা মওকুফ করে দেওয়া হয়। বাকি কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
কোন কারখানার কী অবস্থা: নরসিংদীর ঘোড়াশালের ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেড, পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা, চট্টগ্রামের উত্তর পতেঙ্গার টিএসপি কমপ্লেক্স, ছাতক সিমেন্ট কারখানা, চট্টগ্রামের উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি ও রাঙামাটির চন্দ্রঘোনার কর্ণফুলী পেপার মিলসের কোনো পরিবেশ ছাড়পত্র ও ইটিপি নেই বলে পরিবেশ অধিদপ্তরের ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানিতে ইটিপি থাকলেও পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে তা ত্রুটিপূর্ণ ও অকার্যকর অবস্থায় পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামে ডিএপি ফার্টিলাইজার কোম্পানি, সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের শাহজালাল ফার্টিলাইজার কারখানার পরিবেশ ছাড়পত্র আছে। তবে রাজধানীর মিরপুরের বাংলাদেশ ইনসুলেটর অ্যান্ড স্যানিটারিওয়্যার ফ্যাক্টরির পরিবেশ ছাড়পত্র থাকলেও তার মেয়াদ ২০১২ সালের জুনে শেষ হয়ে গেছে। এই কারখানার দূষণ নিয়ন্ত্রণে কোনো ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া খুলনা হার্ডবোর্ড মিলস, খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলস বর্তমানে বন্ধ রয়েছে।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হাছান মাহমুদ এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলো পরিবেশ আইন মেনে ইটিপি স্থাপন করবে, দূষণ করবে না, এটাই আমরা আশা করি। কিন্তু তারা যদি তা না করে, তাহলে তা দুঃখজনক। দ্রুত তাদের দূষণ রোধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। না হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের উচিত এ ব্যাপারে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া।’
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নরসিংদী প্রতিনিধি মনিরুজ্জামান)