'আমার সন্তান কি নিরাপদে বাড়ি ফিরবে'

গতকাল বখাটের ছুরিকাঘাতে নিহত উইলস লিটল ফ্লাওয়ারের স্কুলছাত্রী সুরাইয়া আক্তার (রিসা) হত্যার বিচারের দাবিতে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আশ্বস্ত করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ l ছবি: প্রথম আলো
গতকাল বখাটের ছুরিকাঘাতে নিহত উইলস লিটল ফ্লাওয়ারের স্কুলছাত্রী সুরাইয়া আক্তার (রিসা) হত্যার বিচারের দাবিতে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আশ্বস্ত করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ l ছবি: প্রথম আলো

‘আমার সন্তান কি নিরাপদে বাড়ি ফিরবে’—এমন জিজ্ঞাসা এক মায়ের। স্কুলছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিসার (১৪) হত্যাকাণ্ডের পর তিনিও তাঁর দুই মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাঁর মেয়েরাও রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ে। এই স্কুলেরই অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া স্কুলের সামনে এক বখাটের ছুরিকাঘাতে আহত হয়ে পরে মারা যায়।
গতকাল সোমবার সুরাইয়ার স্মরণে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের পক্ষ থেকে শোকসভার আয়োজন করা হয়। সভায় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও সুরাইয়ার হত্যাকারীর ফাঁসি দাবি করেন। দুপুরে স্কুল মিলনায়তনে যখন শোকসভাটি চলছিল, তখন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা হত্যাকারীর গ্রেপ্তারের দাবিতে কাকরাইল মোড় অবরোধ করে রাখে। হত্যাকারীকে গ্রেপ্তারে পুলিশের আশ্বাসের পর তাঁরা গতকালের মতো অবরোধ তুলে নেয়।
শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে, মাস ছয়েক আগে স্কুলের পোশাক বানাতে মায়ের সঙ্গে এলিফ্যান্ট রোডের ইস্টার্ন মল্লিকায় ওবায়দুল খান নামের এক দরজির কাছে গিয়েছিল সুরাইয়া। সেই দরজি ফোন নম্বর পেয়ে তাকে উত্ত্যক্ত করতে শুরু করেন। গত বুধবার স্কুলের সামনের পদচারী-সেতুতে সুরাইয়াকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যান ওবায়দুল। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু সবাইকে কাঁদিয়ে গত রোববার সুরাইয়া মারা যায়।
এ ঘটনায় ওবায়দুলকে আসামি করে রমনা থানায় একটি মামলা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত আসামিকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মশিউর রহমান।
গতকালের শোকসভায় শিক্ষামন্ত্রী আক্ষেপ করে বলেন, ‘এটা আমার জন্য অসহনীয় এক দুঃখ, যন্ত্রণা। সুরাইয়ার অসময়ে এ মৃত্যু আমরা মেনে নিতে পারি না।’ তিনি বলেন, সুরাইয়ার হত্যাকারীকে অবিলম্বে গ্রেপ্তারের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হত্যাকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তিনি দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, হত্যাকারীর ছবি ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ছবি দেখে কেউ তাঁকে শনাক্ত করতে পারলে দ্রুত পুলিশকে জানাবেন, যাতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা যায়।
সভায় আঞ্জুমান আরা বেগম নামের এক অভিভাবক বলেন, তাঁর দুই মেয়ের একজন সপ্তম শ্রেণিতে ও অন্যজন উচ্চমাধ্যমিকে পড়ে। তারাও প্রতিদিন বাড়ি ফিরতে ও স্কুলে আসতে স্কুলের সামনে পদচারী-সেতুটি ব্যবহার করে। তিনি বলেন, এখন সব সময় তাদের নিরাপদে বাড়ি ফেরা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। ঘটনার ছয় দিনেও বখাটে ওবায়দুল গ্রেপ্তার না হওয়ায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবুল হোসেন শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সান্ত্বনা জানিয়ে স্কুলের অষ্টম শ্রেণির আইসিটি ল্যাবটি সুরাইয়ার নামে করার ঘোষণা দেন। এ সময় সুরাইয়ার বাবা রমজান হোসেন, মা তানিয়া হোসেন, ছোট দুই ভাই-বোনসহ পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় শিক্ষামন্ত্রী ও অন্য অভিভাবকেরা তাঁদের সান্ত্বনা দেন। কিন্তু মেয়ের ছবি দেখে কিছুক্ষণ পরপরই ডুকরে কেঁদে ওঠেন মা তানিয়া হোসেন। বাবা রমজান মেয়ের হত্যাকারীর ফাঁসি দাবি করেন।
সুরাইয়ার ছোট ভাই রবি হোসেন প্রথম আলোকে বলে, তার দুই বোন সুরাইয়া ও রোদেলা আক্তার একসঙ্গেই স্কুলে আসত। বড় বোনের মৃত্যুর পর রোদেলা চুপচাপ হয়ে গেছে। খুব একটা কথা বলে না।
এদিকে দুপুর ১২টার দিকে স্কুলটির বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা কাকরাইল মোড় অবরোধ করে। তারা ওবায়দুলের গ্রেপ্তার ও ফাঁসির দাবিতে স্লোগান দিতে থাকে। অবরোধের কারণে ওই মোড় দিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে বেলা দেড়টার দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) শিবলী নোমান ঘটনাস্থলে আসেন ও শিক্ষার্থীদের অবরোধ তুলে নেওয়ার অনুরোধ করেন। তিনি শিক্ষার্থীদের বলেন, পুলিশের কাছে কেবল খুনি ওবায়দুলের নাম ছিল। এখন তাঁর স্থায়ী, অস্থায়ী ঠিকানা ও ছবি পাওয়া গেছে। তাঁকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি সময়ের ব্যাপারমাত্র। আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিকে গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিয়ে তিনি শিক্ষার্থীদের অবরোধ তুলে নেওয়ার অনুরোধ জানান।
বেলা দুইটার দিকে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার সেখানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। সোয়া দুইটার দিকে শিক্ষার্থীরা দুই দফা কর্মসূচি দিয়ে অবরোধ তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। আজ দুপুর ১২টার মধ্যে বখাটে ওবায়দুল গ্রেপ্তার না হলে ১২টা থেকেই আবার সড়ক অবরোধ ও ৩১ আগস্ট সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুপুর ১২টায় মানববন্ধন ও শোক সমাবেশের ঘোষণা দেয় শিক্ষার্থীরা। বেলা আড়াইটার দিকে ওই এলাকার যান চলাচল শুরু হয়।