প্রাকৃতিক পদ্ধতিতেই ভবদহের সমাধান

দূর গ্রাম থেকে নৌকায় করে খাওয়ার পানি নিয়ে আসছেন নারীরা। মনিরামপুর উপজেলার হাটগাছা এলাকা থেকে ছবিটি তুলেছেন এহসান–উদ–দৌলা
দূর গ্রাম থেকে নৌকায় করে খাওয়ার পানি নিয়ে আসছেন নারীরা। মনিরামপুর উপজেলার হাটগাছা এলাকা থেকে ছবিটি তুলেছেন এহসান–উদ–দৌলা

যশোরের ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসনের একমাত্র উপায় প্রকৃতিকে তার স্বাভাবিক গতিতে চলতে দেওয়া। এলাকার ভুক্তভোগী মানুষ, আন্দোলনরত সংগ্রাম কমিটির নেতারা এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের মত হলো, এই অঞ্চলকে পানিমুক্ত করতে দরকার প্রাচীন জোয়ারাধার পদ্ধতি চালু করা। পাশাপাশি চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় মাথাভাঙ্গা-পদ্মার সঙ্গে ভৈরব নদের সংযোগ পুনস্থাপিত করে ভৈরব নদ এবং মুক্তেশ্বরী নদী সংস্কার করা। এতে এলাকার নদীগুলো স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরে পাবে।
ভবদহ অঞ্চলের পানি ওঠানামা করে মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদী দিয়ে। চলমান জলাবদ্ধতার মূল কারণ বাঁধ ও স্লুইসগেটের কারণে পলি জমে এই নদীগুলোর তলদেশ উঁচু হয়ে পড়া; আর এলাকার বিলগুলো নদীর তুলনায় নিচু হয়ে যাওয়া। তাই টানা বর্ষণ হলে বিল উপচে পুরো ভবদহ অঞ্চল পানিতে তলিয়ে যায়।
যশোরের চৌগাছা উপজেলার পাশে মজ্জাতের বাঁওড়ের বিপরীত দিকে ভৈরব নদ থেকে বেরিয়ে মুক্তেশ্বরী নদী যশোর সদর ও মনিরামপুর উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এরপর অভয়নগর উপজেলার গোঘাটা নামক স্থানে টেকা নাম ধারণ করেছে নদীটি। টেকা নদী উপজেলার ভবানীপুর এলাকায় শ্রী নদীতে পতিত হয়েছে। শ্রী নদী কিছুদূর এগিয়ে মনিরামপুর উপজেলার কপালিয়ায় হরি নদীর সঙ্গে মিশেছে। হরি খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গ্যাংরাইল নদীতে পতিত হয়েছে। সাগর থেকে আসা জোয়ারের পানি প্রতিদিন দুবার নদীগুলো দিয়ে ভবদহ অঞ্চলে প্রবেশ করে। আবার একইভাবে সাগরে ফিরে যায়।
ভবদহ পানিনিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রণজিৎ কুমার বাওয়ালী প্রথম আলোকে বলেন, বাঁধ, পোল্ডার ও স্লুইসগেট নির্মাণ করে ভবদহ এলাকায় প্রকৃতির গতিকে রোধ করা হয়েছে। ভবদহের জলাবদ্ধতা হচ্ছে প্রকৃতির প্রতিশোধ।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষকদের শত বছরের পুরোনো নিজস্ব উদ্ভাবিত নাম জোয়ারাধার বা টিআরএম (টাইডল রিভার ম্যানেজমেন্ট। মূল নদীসংলগ্ন যেকোনো একটি নির্বাচিত বিলের তিন দিকে বাঁধ দিয়ে অবশিষ্ট দিকের বেড়িবাঁধের একটি অংশ উন্মুক্ত করে বিলে জোয়ারভাটার পানি ঢোকানো হতো। এই পদ্ধতিতে সাগর থেকে জোয়ারের সঙ্গে আসা পলি পর্যায়ক্রমে এলাকার একটি করে বিলে ফেলে বিল উঁচু করা হতো। আর ভাটার সময় স্বচ্ছ পানি সাগরে ফিরে যাওয়ার সময় স্রোতের টানে নদী নাব্য থাকত। জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতো না।

কেশবপুরের মধ্যকূল এলাকায় যশোর-সাতক্ষীরা আঞ্চলিক সড়কের ওপর আশ্রয় নিয়েছে কয়েক শ পরিবার
কেশবপুরের মধ্যকূল এলাকায় যশোর-সাতক্ষীরা আঞ্চলিক সড়কের ওপর আশ্রয় নিয়েছে কয়েক শ পরিবার

গত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাঁধ নির্মাণ করে জোয়ারের লোনা পানি বিলে ঢোকা বন্ধ করা হয়। বিলের ভেতরে খালের মুখে স্লুইসগেট নির্মাণ করে ভেতরের পানি নিষ্কাশন করা হয়। একে পোল্ডার বলে। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার বাঁধ, ২৮২টি স্লুইসগেট ও ৩৭টি পোল্ডার বানানো হয়। যশোর ও খুলনা জেলার পাঁচটি উপজেলার সংযোগস্থল অভয়নগরের ভবদহে ২৪ নম্বর পোল্ডারের আওতায় শ্রী নদীর ওপর নির্মিত হয় ভবদহ স্লুইসগেট। এলাকার ২৭টি বিলের পানি সরাসরি এবং ২৬টি বিলের পানি পরোক্ষভাবে নিষ্কাশিত হতো এই স্লুইসগেট দিয়ে। এতে বিলে পলি আসা কমে যায় এবং থেমে যায় প্রাকৃতিক ভূমি গঠন প্রক্রিয়া। পলি জমতে থাকে নদীর বুকে।
আশির দশকের শুরুতে স্লুইসগেটগুলোর বাইরে পলি জমে বাঁধের বাইরের নদী বাঁধের ভেতরের নদী ও ভূমি থেকে উঁচু হয়ে যায়। নাব্যতা হারায় মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদী। বৃষ্টির পানি আটকা পড়ে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। ১৯৮৪ সাল থেকে এই জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করে। পানি সরানোর দাবিতে আন্দোলন শুরু করে ভুক্তভোগী মানুষ।
ভুক্তভোগী লোকজন জানান, ১৯৯৭ সালে এলাকার কৃষকেরা জলাবদ্ধতার হাত থেকে বাঁচতে হরি নদীর বাঁধ কেটে দিয়ে কেশবপুর উপজেলার ভয়তভায়না বিলে জোয়ার ওঠান। জোয়ারের সঙ্গে আসা পলিতে বিল উঁচু হয়ে ওঠে। নেমে যাওয়া স্বচ্ছ পানিতে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি পায় ব্যাপকহারে। তাঁরা জানান, ষাটের দশকে উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্প চালু করার পর এটাই কৃষকদের ‘স্বতঃস্ফূর্ত জোয়ারাধার’। ২০০১ সাল পর্যন্ত চলে এ জোয়ারাধার।
প্রথম দিকে বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিলেও পরে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কৃষকদের এ লোকজ অভিজ্ঞতা গ্রহণ করে। আন্দোলনের মুখে খুলনা-যশোর পানিনিষ্কাশন প্রকল্পে (কেজেডিআরপি) কাজ শুরু হয়। শ্রী, হরি ও টেকা নদীর পলি অপসারণ, খাল খনন এবং বিল কেদারিয়ায় জোয়ারাধার নির্মাণ করা হয় এই প্রকল্পের আওতায়। ২০০২ সালে আপাতত অবসান হয় জলাবদ্ধতার। ২০০৪ সাল পর্যন্ত চলে এ জোয়ারাধার। এ সময় এলাকায় কোনো জলাবদ্ধতা ছিল না।

মানুষ, গবাদিপশু সবাই দুর্গত। অভয়নগর-কালিবাড়ি সড়কের চিত্র
মানুষ, গবাদিপশু সবাই দুর্গত। অভয়নগর-কালিবাড়ি সড়কের চিত্র

২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্থানীয় বিএনপির নেতা বর্তমানে মনিরামপুর উপজেলার নেহালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নজমুস সাদাতসহ ৪৮৩ ব্যক্তি বিল কেদারিয়ায় জোয়ারাধার বন্ধের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন। এলাকার মৎস্যঘেরের মালিক, খাসজমি দখলকারী ও রাজনৈতিক স্বার্থবাদীরা জোয়ারাধারের বিরুদ্ধে অবস্থায়ন নেন। জেলা প্রশাসকের নির্দেশে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৪৮ দিন ভবদহ স্লুইসগেট বন্ধ রাখে। এতে পলি জমে নদীর বুক আবার উঁচু হয়ে পড়ে। ওই বছরের অক্টোবরে এবং ২০০৬ সালের চার দফা অতিবর্ষণে অভয়নগর, মনিরামপুর, কেশবপুর ও যশোর সদর উপজেলার ২১টি ইউনিনের ১৮৪টি গ্রাম তলিয়ে যায়। পানিবন্দী হয়ে পড়ে চার লক্ষাধিক মানুষ। পানি সরানোর দাবিতে ‘ভবদহ পানিনিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি’র নেতৃত্বে শুরু হয় আন্দোলন। তীব্র আন্দোলনের মুখে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ওই বছর শ্রী, হরি ও টেকা নদী পুনরায় খনন করা হয়। কেশবপুর উপজেলার বিল খুকশিয়ায় জোয়ারাধার চালু এবং অভয়নগর উপজেলার আমডাঙ্গা খাল সংস্কার করা হয়। শুরু হয় পানিনিষ্কাশন। দূর হয় জলাবদ্ধতা।
বিল খুকশিয়ার পর দ্বিতীয় বিল হিসেবে অভয়নগর ও মনিরামপুর উপজেলায় অবস্থিত বিল কপালিয়ায় জোয়ারাধার চালুর চেষ্টা চালায় পাউবো। ফসলের অগ্রিম ক্ষতিপূরণ দিতে চাইলেও বিলের বেশির ভাগ কৃষক আবেদনই করেননি। এ অবস্থায় বিল কপালিয়ায় জোয়ারাধার নির্মাণ করতে গেলে জোয়ারাধারবিরোধীদের হামলায় যশোর-৬ আসনের তখনকার সাংসদ শেখ আব্দুল ওহাব, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাসহ ২৬ জন আহত হন। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে গোরসয়ালে হরি নদীর সঙ্গে বিল খুকশিয়ার কাটিং পয়েন্ট বেঁধে দেন বিক্ষুব্ধ কৃষকেরা। বন্ধ হয়ে যায় বিল খুকশিয়ায় জোয়ারাধার।
এরপর সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বিল কপালিয়ায় জোয়ারাধার চালুর জন্য আবেদন করে পাউবো। ২০১৪ সালে মন্ত্রিসভায় তা অনুমোদন করা হয়। সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ডিজেল প্লান্ট লিমিটেডকে (বিডিপিএল) কার্যাদেশ দেয় পাউবো। ওই বছরের ২২ নভেম্বর বিডিপিএল প্রকল্প এলাকায় কাজের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে পাউবোকে চিঠি দেয়। এরপর গত বছরের ২৯ জুলাই পরিকল্পনা কমিশন চিঠি দিয়ে প্রকল্পটি বন্ধ করতে নির্দেশ দেয়।

এক্সকাভেটর দিয়ে ভবদহ স্লুইসগেটের সামনে শ্রী নদী থেকে পলি অপসারণ করা হচ্ছে
এক্সকাভেটর দিয়ে ভবদহ স্লুইসগেটের সামনে শ্রী নদী থেকে পলি অপসারণ করা হচ্ছে

অভয়নগর উপজেলার বারান্দী গ্রামের কৃষক মাসুদ হাসান বলেন, ‘টিআরএম হলে এলাকার একটা বিলের ক্ষতি হয়, কিন্তু নদী বাঁচে, এলাকা বাঁচে। এখন টিআরএম নেই। মরে গেছে নদী। পানিতে তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি ও ফসলের খেত। বাঁচার আর কোনো পথ নেই।’
ভবদহ ও তৎসংলগ্ন বিল এলাকায় জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্পের পরিচালক এবং খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যশোর পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ সার্কেল) জুলফিকার আলী হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন করে সমীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সমীক্ষা শেষ করে পুনরায় জোয়ারাধার বাস্তবায়ন করতে প্রায় এক বছর সময় লাগবে।
ভবদহ পানিনিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ প্রথম আলোকে বলেন, এখন সবাই বোঝেন টিআরএম ছাড়া জলাব্ধতা থেকে বাঁচার কোনো পথ নেই। কৃষকদের বুঝিয়ে এবং ক্ষতিপূরণ দিয়ে বিলে টিআরএম বাস্তবায়ন করতে হবে।
কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলনের আহ্বায়ক অনিল বিশ্বাস বলেন, ‘পর্যায়ক্রমে একটি করে বিলে জোয়ারাধার বাস্তবায়ন করে ভবদহের জলাবদ্ধতা দূর করা সম্ভব। একই সঙ্গে দর্শনায় মাথাভাঙ্গা-পদ্মার সঙ্গে ভৈরব নদের সংযোগ পুনঃস্থাপিত করে ভৈরব নদ এবং মুক্তেশ্বরী নদী সংস্কার করতে হবে। তবেই এলাকার নদীগুলোতে পানির প্রবাহ সৃষ্টি হবে। দূর হবে জলাবদ্ধতা।’ [ শেষ ]