পাহাড়ের মুক্তা নাফাখুম
মাথার ওপরে নীল আকাশে রৌদ্র-ছায়ার খেলা। নিচে খরস্রোতা নদীর ধেয়ে আসা জলের ছলাৎ ছলাৎ ধ্বনি। প্রায় ৩০ ফুট ওপর থেকে আছড়ে পড়া পানির প্রচণ্ড আঘাতে ঝরনার চারপাশে অনেকটা স্থানজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে ঘন কুয়াশা। সূর্যের আলো এই জলপ্রবাহের খেলায় সৃষ্টি করেছে রংধনু। চারদিকে বড় বড় পাহাড়। নদীতে ছড়ানো অজস্র পাথর। পাথরগুলো যেন একেকটি ভাস্কর্য। এমন দৃশ্য উপভোগ করতে হলে যেতে হবে বান্দরবানের থানিচ উপজেলার রেমাক্রির নাফাখুম ঝরনায়।
ভরা বর্ষা থাকায় এবার বান্দরবানের পাহাড়ি ঝরনাগুলোও ছিল পানিতে টইটম্বুর। আর সেপ্টেম্বরেই নাফাখুম ঝরনা দেখার উপযুক্ত সময়। তাই দেরি না করে রওনা দিলাম ঈদুল আজহার পরদিন। বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও ঢাকার ১৮ জন তরুণের সঙ্গী হলাম এই যাত্রায়। দল ভারী হওয়ায় সবদিক থেকে সাশ্রয়ী হলো ভ্রমণটাও।
ঈদের পরের দিন ১৪ সেপ্টেম্বর চাঁদের গাড়িতে (জিপ) বান্দরবান থেকে থানচির উদ্দেশে আমাদের যাত্রা শুরু। পথে পড়ল মেঘছেঁায়া খাড়া পাহাড় আর এঁকেবেঁকে বয়ে চলা সাঙ্গু নদী। সাঙ্গু নদীর তীরেই থানচির উপজেলা সদর। পাহাড়ঘেরা থানচির মাথার ওপরে সাদা মেঘের ভেলা। থানচি বাজারের সারা দিন এখানে-ওখানে ঘুরে, রাত কাটিয়ে পরের দিন ভোরে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় রেমাক্রি বাজারের পথে যাত্রা শুরু।
যেতে যেতে গাইড উ শৈ মংয়ের কাছ থেকে জানা গেল নাফাখুম নামের বৃত্তান্ত।। মারমা ভাষায় ‘নাফা’ হলো স্রোতের বিপরীতে চলা এক ধরনের মাছ। আর ‘খুম’ শব্দের অর্থ ঝরনা। এ থেকে নামকরণ হয়েছে নাফাখুম ঝরনার।
উ শৈ মং জানালেন, বর্ষায় সাঙ্গু খরস্রোতা থাকে। তাই বর্ষার শেষে সেপ্টেম্বরেই নাফখুমে বেড়াতে যাওয়ার জন্য সঠিক সময়। তবে নদীর স্রোত বুঝিয়ে দিল, এখনো সে শান্ত বা বাধ্য হয়ে ওঠেনি। রেমাক্রির পথে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল সকাল সাড়ে আটটায়। চার ঘণ্টার এই নৌ ভ্রমণে সঙ্গী ছিল বড় বড় ঢেউ।
নৌকা চলতে শুরু করার পর এক ঘণ্টার মাথায় তিন্দুতে পৌঁছানো গেল। থানচি থেকে নাফাখুম যাওয়ার পথে পর্যটকদের তিন্দু ও বড় পাথর নামের দুটি স্থান পাড়ি দিতে হয়। তিন্দুতে পর্যটকদের জন্য রাতে থাকার ব্যবস্থাও রয়েছে। তিন্দু থেকে কিছুটা পথ সামনে এগোলেই বড় পাথর। স্থানীয় লোকদের বিশ্বাস, চলতি পথে এই পাথরকে সম্মান প্রদর্শন করতে হয়, নয়তো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। স্থানীয় লোকজন এই পাথরকে রাজা পাথর বলেও সম্বোধন করে।
সাঙ্গু নদীতে এ সময়ে তীব্র স্রোত থাকায় পর্যটকদের বড় পাথরের কাছে এসে নৌকা থেকে নেমে কিছু দূর হাঁটতে হয়। এরপর আবার নৌকায় ওঠার পর মনে হলো, পাহাড়ের চড়াই বেয়ে উঠছি। মাঝে মাঝে হঠাৎ বড় আকারের ঢেউ দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল নৌকা। দুই পাশে খাড়া পাহাড় ক্যালেন্ডারের নিসর্গ দৃশ্যের মতো দাঁড়িয়ে। এভাবে ঘণ্টা চারেক চলার পর নৌকা এসে পৌঁছায় রেমাক্রি খালে।
রেমাক্রি বাজারে নেমে উ শৈ মংয়ের ঠিক করে রাখা রেস্ট হাউজে উঠি আমরা। তখন দুপুর সাড়ে ১২টা। ব্যাগপত্র রেখে ঘণ্টা খানেক পর আবার নৌকায় নাফাখুমের উদ্দেশে যাত্রা শুরু। ঠিক হলো বিকেলের মধ্যে নাফাখুম দেখে রাতটা রেমাক্রিতেই কাটাব।
রেমাক্রি থেকে নাফাখুমের পথটা আরও দুর্গম। তবে পথ যত দুর্গম হচ্ছিল, ততই বাড়ছিল প্রকৃতির ঐশ্বর্য। খাল পাড়ি দিতে দিতে চোখে পড়ল অসংখ্য জলপ্রপাত ও পাথর। পাহাড়ের মাঝে ঘন জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে বয়ে চলছে জলস্রোত। জঙ্গল থেকে ভেসে আসছিল নানা প্রজাতির পাখির ডাক। প্রায় দুই ঘণ্টা নৌকায় পাড়ি দেওয়ার পর আমরা নেমে পড়ি। এখান থেকে ঝরনা পর্যন্ত যেতে হবে হেঁটে। খালের পাড় দিয়ে সংকীর্ণ পায়ে চলা পথ। প্রায় আধঘণ্টা হাঁটার পর মোটা শক্ত দড়ি ধরে নদীও পার হতে হলো। এরপর আবারও হাঁটা শুরু। আরও আধঘণ্টা হাঁটার পর কানে এল প্রবল জলপতনের শব্দ। গর্জনে কানে তালা লেগে যাচ্ছিল। হঠাৎই চোখের সামনে হাজির বিশাল পাথর ভেঙে গড়িয়ে পড়া উচ্ছল জলরাশি। এটাই নাফাখুম! বিস্ময়ে তখন অনেকেরই মুখের কথা সরছে না। পাথর ভেঙে জল প্রায় ৩০ ফুট নিচে গড়িয়ে পড়ছে। ঝরনা ঘিরে জলের ফোঁটা তৈরি করেছে রংধনু। এক লহমায় যেন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। তৃষ্ণা না মিটতেই গাইড তাড়া দিলেন রেমাক্রিতে ফেরার। সূর্যের আলো নিভে যাওয়ার আগেই আমরা ফিরতি পথ ধরি।
কীভাবে যাবেন: চট্টগ্রাম বহদ্দারহাট টার্মিনাল বাসে বান্দরবান। সেখান থেকে আবার বাস বা জিপে থানচি যাওয়া যায়। চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবান বাসভাড়া ১১০ টাকা, বান্দরবান থেকে থানচির বাসভাড়া ২০০ টাকা। থানচি থেকে নাফাখুম পর্যন্ত গাইডকে দিতে হবে দুই হাজার টাকা।
সতর্কতা: নাফাখুম যেতে হলে দলবল নিয়ে যাওয়াই ভালো। এ ছাড়া ভ্রমণের উল্লেখযোগ্য অংশ নৌপথে। তাই সাঁতার না জানলে এই ভ্রমণে অংশ নেওয়া ঠিক হবে না। পাশাপাশি নৌকায় ওঠার আগে লাইফ জ্যাকেট সঙ্গে নিতে ভুলবেন না। কাদায় ও পাহাড়ে হাঁটার উপযুক্ত জুতা পরতে হবে। এ ছাড়া ছুরি, টর্চ, ফার্স্ট এইড, দড়িসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র সঙ্গে রাখতে হবে।