৪৯ বিশিষ্টজনের বিবৃতি: ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার না করতে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সার্কুলার আমলাতান্ত্রিক ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ

‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার না করতে সম্প্রতি তথ্য মন্ত্রণালয় গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে চিঠি দিয়েছে, তাতে ক্ষোভ জানিয়েছেন দেশের ৪৯ বিশিষ্ট নাগরিক। তাঁরা বলেছেন, এ ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে বাক্‌স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে। এটি সংবিধান পরিপন্থী। তাঁরা এই সার্কুলারকে ‘আমলাতান্ত্রিক ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ’ আখ্যা দিয়ে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। আজ শনিবার দেওয়া এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানান বিশিষ্টজনেরা।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার না করতে ১৯ জুলাই তথ্য মন্ত্রণালয় গণমাধ্যমগুলোকে একটি চিঠি দেয়। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শেখ শামছুর রহমানের সই করা ওই চিঠিতে টেলিভিশনগুলোর কর্তৃপক্ষকে বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন ছোট ছোট সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা নৃগোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ অবস্থায় আগামী ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত টক শোতে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ এবং সংবাদপত্রের সম্পাদকসহ সুশীল সমাজের অন্য ব্যক্তিদের বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করার বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে প্রচারের জন্য অনুরোধ করা হয়।

বিশিষ্টজনেরা ওই সার্কুলারের বিষয়ে ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘যে সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় এই সার্কুলার প্রচার করেছে, সেই সরকারের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের ২৮(ক) ধারায় একাধিকবার আদিবাসী শব্দটি স্পষ্ট করে ব্যবহার করা হয়েছে।’

বিবৃতিদাতারা বলেন, ‘এই সার্কুলারটি আসলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার পরিপত্রকে ভিত্তি করেই রচিত এবং তার অনুলিপি হিসেবেই প্রচার করা হয়েছে। কোন শব্দটি সংবিধানসম্মত কিংবা অসাংবিধানিক, তা নির্ধারণ করার এখতিয়ার একটি গোয়েন্দা অধিদপ্তর কিংবা তথ্য মন্ত্রণালয়ের সার্কুলার প্রণয়নকারীদের কাছে কখন কীভাবে গেল, তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগের সঙ্গে আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে এটি চরম অনধিকারচর্চার পর্যায়ে পড়ে, যা মোটেই কাম্য নয়, আইনসম্মতও নয়।’

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমাদের দেশের সংবিধানে সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে সংবিধানের কোনো ধারা বা বিষয় নিয়ে কোনো বিতর্ক বা মতান্তর দেখা দিলে তার ব্যাখ্যা একমাত্র দেশের সর্বোচ্চ আদালত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টই দিতে পারবে। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী বা ব্যক্তি নয়। আর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টেরই এক রায়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহারে কোনো আইনগত প্রতিবন্ধকতা নেই।’

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারই ১৯৭২ সালে যে আইএলও কনভেনশন ১০৭ অনুস্বাক্ষর করে গেছেন, সেখানেও আদিবাসী বা Indigenous শব্দটি শুধু ব্যবহারই নয়, তাদের সব অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া কয়েক মেয়াদে ক্ষমতাসীন বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে আদিবাসী দিবস উপলক্ষে তাঁর দেওয়া বাণীতে আদিবাসীদের নিজস্ব পরিচয়ে সব অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ওপর বলিষ্ঠ ভাষায় গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।’

আজ দেওয়া বিবৃতিতে বিশিষ্টজনেরা বলেন, ‘সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের ২(ক) ও ২(খ) ধারায় যে বাব্‌স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দেওয়া রয়েছে, তাতেও এই সার্কুলারে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে। একজন কী কী শব্দ চয়ন করলেন, তাতে রাষ্ট্রের কারও কিছু বলার নাই, যদি এই শব্দ ব্যবহারে অন্য কারও প্রতি বিদ্বেষ বা ঘৃণা না ছাড়ানো হয়।’

বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন হামিদা হোসেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সুলতানা কামাল, বদিউল আলম মজুমদার, শিরীন হক, অধ্যাপক পারভীন হাসান, খুশী কবির, ইফতেখারুজ্জামান, মোস্তাফিজুর রহমান, ফেরদৌস আজীম, আবুল বারকাত, রানা দাশগুপ্ত, মেঘনা গুহঠাকুরতা, আহরার আহমেদ, জেড আই খান পান্না, শারমিন মুর্শিদ, রেহনুমা আহমেদ, শহিদুল আলম, শাহীন আনাম, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, গীতি আরা নাসরিন, সুমাইয়া খায়ের, তবারক হোসাইন, সারা হোসেন, শামসুল হুদা, কাজল দেবনাথ, রোবায়েত ফেরদৌস, শাহনাজ হুদা, সুব্রত চৌধুরী, সঞ্জীব দ্রং, সামিনা লুৎফা, মোহাম্মদ তানজিম উদ্দিন খান, জাকির হোসেন, তাসনিম সিরাজ মাহবুব, বীনা ডি’ কস্টা, মো. নুর খান, রানী ইয়েন ইয়েন, জোবাইদা নাসরীন, নোভা আহমেদ, রেজাউল করিম চৌধুরী, জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, নীনা গোস্বামী, দীপায়ন খীসা, মাহরুখ মহিউদ্দিন, পল্লব চাকমা, রেজাউল করিম লেনিন, সায়দিয়া গুলরুখ, হানা শামস আহমেদ ও অরূপ রাহী।