জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অনেক রক্তের বিনিময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পরিবর্তন হলেও আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন হয়নি। দেশে এখনো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়নি। নিজেদের মধ্যে কথা বলে দূরত্ব কমিয়ে আনতে হবে; যাতে নানা স্বার্থের মানুষ হাতে হাত মিলিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারে।
আজ শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘জেন-জি’র প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি: গ্রাফিতির আলপনায় ৩৬ জুলাই’ শীর্ষক গ্রাফিতি প্রদর্শনী ও মতবিনিময় সভায় বক্তারা এ কথা বলেন। এ অনুষ্ঠান আয়োজন করে নীতি গবেষণা কেন্দ্র। আয়োজকেরা জানান, ২০০৪ সালে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা হয়।
মতবিনিময় সভায় মুখ্য আলোচক হিসেবে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মানজুর আল মতিন। তিনি বলেন, নারীরা জানেন, তাঁরা বেরিয়ে আসতে পারেন। মাদ্রাসার ছাত্ররা জানেন, তাঁরা রাস্তায় বেরিয়ে আসতে পারেন। এই বেরিয়ে আসাটা একটা শুভ উদ্দেশ্যে হোক। যাতে নানা ধরনের মানুষের নানা স্বার্থ, তার মধ্যে যেটুকু এক, সেটার ব্যাপারে একমত হয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায়। তাহলে পরিবর্তন আসবে, সেটা জুলাইয়ের মতো রক্তস্নাত পদ্ধতিতে নয়।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ১ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু, সেটি কাম্য নয় উল্লেখ করে মানজুর আল মতিন বলেন, এটি যদি বারবার হতে থাকে, সেটি একটা দেশের জন্য ভালো কিছু নয়। তাই চেষ্টা থাকতে হবে কথা বলে নিজেদের মধ্যে দূরত্বটা ঘোচানোর। এই যে শত্রুতার দেয়াল বছরের পর বছর তোলা হয়েছে, সেটা একেবারে ধ্বংস করা না গেলেও অন্তত উচ্চতায় ছোট করে আনতে হবে। নিজেদের মধ্যে মিল খুঁজে পেয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া যেতে পারে। নানা স্বার্থের মানুষ বাংলাদেশে যাতে অন্তত হাতে হাত মিলিয়ে সামনে এগোতে পারে, সেই প্রত্যাশা করেন তিনি।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের দেয়ালে আঁকা ১০ হাজারের বেশি গ্রাফিতির ছবি তুলেছেন সাংবাদিক ও গবেষক মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান। সেসব গ্রাফিতি তিনি এ আয়োজনে উপস্থাপন করেন। মাহমুদুজ্জামান মনে করেন, জেন-জিরা অবহেলিত প্রজন্ম। করোনা তাদের দুই বছর নষ্ট করেছে। অনেকের দুই বছরের কলেজজীবন নেই। এই প্রজন্ম নিয়ে নানা ধরনের নেতিবাচক কথা রয়েছে। প্রচলিত ছিল, তারা খিটখিটে মেজাজের, কারও সঙ্গে মেশে না, দেশপ্রেমিক না, কাউকে অনুভব করে না প্রভৃতি। এই সবকিছুই আসলে মিথ্যা।
বরিশালের একটি গ্রাফিতির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মাহমুদুজ্জামান বলেন, এই প্রজন্ম মনে করে, ৩৬ জুলাই নতুন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ নতুনভাবে জন্মগ্রহণ করেছে। তারা আশা করে যে বাংলাদেশ একটা স্বর্গভূমি হবে। তাদের কারণে বাংলাদেশ একদিন মাথা তুলবে বলে বিশ্বাস করেন তিনি।
গণ-অভ্যুত্থানের সময় ও পরে শিক্ষার্থীদের আঁকা গ্রাফিতি নষ্ট হতে শুরু করেছে উল্লেখ করে মাহমুদুজ্জামান বলেন, অন্তত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার গ্রাফিতিগুলো সরকারের রক্ষা করা উচিত।
মতবিনিময় সভা সঞ্চালনা করেন নীতি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী শাকিল আহম্মেদ। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, এই প্রজন্ম নীতি প্রস্তাব গ্রহণ করতে প্রস্তুত। তাদের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দিতে হবে।
সমাপনী বক্তব্যে নীতি গবেষণা কেন্দ্রের গবেষণা ফেলো খান শরীফুজ্জামান বলেন, দেশে বেশ কয়েকবার গণ-অভ্যুত্থান হলো। এই দেশের মানুষ কয়েক বছর পরপর গণ-অভ্যুত্থান করতেই থাকবে কি না, সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি।
খান শরীফুজ্জামান বলেন, দেশের রাজনৈতিক দলগুলো বাইরের শক্তির দ্বারা প্রচণ্ড আকারে নিয়ন্ত্রিত। অনেকে প্রশ্ন করেন, রাজনীতি আসলে দেশের মানুষের আছে কি না। আগে ‘এ’ সুপার পাওয়ার নিয়ন্ত্রণ করত। এখন একটা ‘বি’ সুপার পাওয়ারের কাছে চলে গেছে। নতুন প্রজন্মকে এ বিষয় ভাবতে হবে। প্রকৃত মুক্তি এবং স্বাধীনতার সুখ পেতে চাইলে অবশ্যই নতুন ব্যবস্থা, নতুন আদর্শ এবং নতুন ব্যবস্থা দরকার।
‘শুধু গাড়ির চালক বদলেছে’
অনুষ্ঠানে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও বক্তব্য দেন। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের রিনভী মোশাররফ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম কমিটিতে সমন্বয়ক ছিলেন। তিনি অভিযোগ করেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একপক্ষীয় হয়ে গেছে, যেটা সবার প্রতিনিধিত্ব করতে পারছে না। মোশাররফ বলেন, যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আন্দোলনে এসেছিলেন, তার প্রতিফলন পাচ্ছেন না।
শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী মর্তুজা মীম বলেন, মানুষ একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চেয়েছিল। গণতন্ত্র মুখে বলে গেলেও তা পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু গাড়ির চালক বদলেছে।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী মিরাজ হাসান বলেন, নতুন সরকার এসেছে; রাজনৈতিক ভাবনা, পরিবর্তন–কিছুই হয়নি।
আরেক শিক্ষার্থী মো. মেহেদি হাসান বলেন, গণ-অভ্যুত্থানে বাল্যবন্ধুকে হারিয়েছেন তিনি। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশের উন্নয়ন হবে এবং গণতান্ত্রিক সরকার পাবেন বলে ভেবেছিলেন তিনি। কিন্তু এখনো তা পাওয়া যায়নি বলে তাঁর অভিযোগ।
আরও বক্তব্য দেন মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী তানজিয়া শিশির, একই কলেজের শিক্ষার্থী মীর নিজাম আহমেদ প্রমুখ।