বিধি না মেনে এলজিইডির খরচ, সরকারের ক্ষতি ৩১৭ কোটি টাকা

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) নিজেদের কাজের বাইরে সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের পূর্তকাজ করে দেয়। এই কাজের জন্য সংস্থাটি ২ শতাংশ হারে ‘সার্ভিস চার্জ’ নেয়। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী, সার্ভিস চার্জ হিসেবে আদায় করা ৩১৭ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি এলজিইডি। বিধি না মেনে এলজিইডি এসব টাকা খরচ করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।

এলজিইডির আদায় করা এই সার্ভিস চার্জকে দাপ্তরিকভাবে ‘ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয়’ বলা হয়। এলজিইডি কর্তৃপক্ষ বলছে, এই সাপোর্ট ব্যয় কোন কোন খাতে খরচ করা যাবে, সে-সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা আগে ছিল না। এ কারণে জটিলতা তৈরি হয়েছিল। এসব খরচ নিয়ে নিরীক্ষা আপত্তির পর থেকে এলজিইডির আদায় করা সাপোর্ট ব্যয় সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হচ্ছে। সরকার চলতি বছর ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয়-সংক্রান্ত নীতিমালা করেছে। এখন সে অনুযায়ী কার্যক্রম চলছে।

১৯৯০ সাল থেকে এলজিইডি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রাথমিক শিক্ষা অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করছে। এসব প্রকল্পের অধীনে প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো নির্মাণ, সম্প্রসারণ, সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ ও বড় ধরনের মেরামত কাজ করা হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, নির্বাচন কমিশন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের পূর্তকাজও করে এলজিইডি। এসব প্রকল্প থেকেই এলজিইডি ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয় নিয়েছে।

মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে এলজিইডির ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয়ের বিষয়ে ২০১৪ সালে একটি নিরীক্ষা করা হয়। নিরীক্ষা প্রতিবেদনটির বিষয়ে ২০১৮ সালের মার্চ মাসে দশম জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, এলজিইডি নিজেদের কাছে কোনো টাকা রাখবে না। এলজিইডি সাপোর্ট ব্যয়ের কতটা ব্যয় করতে পারবে, তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নির্দিষ্ট করে দেবে। সাপোর্ট ব্যয় থেকে অর্থ খরচের বিস্তারিত হিসাব স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে দেবে অধীনস্ত সংস্থা এলজিইডি। মন্ত্রণালয় তা নিরীক্ষা কার্যালয়কে জানিয়ে দেবে।

জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির এসব সিদ্ধান্ত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এলজিইডি অনুসরণ করেনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাপোর্ট ব্যয়ের বিষয়ে বিশেষ নিরীক্ষা করার নির্দেশনা দেন।

নির্দেশনা অনুসারে, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ৯টি, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের ১টি, নির্বাচন কমিশনের ১টি, কৃষি মন্ত্রণালয়ের ১টিসহ মোট ১২টি প্রকল্প থেকে এলজিইডির গ্রহণ করা ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয়ের ব্যবহারের ওপর বিশেষ নিরীক্ষা করা হয়। ২০২০ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাসে এই নিরীক্ষা হয়।

নিরীক্ষায় এলজিইডি বিধিবিধান অনুসরণ না করে বেশ কিছু খাতে টাকা খরচ করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি সামনে আসে।

প্রকল্প শেষ হওয়ার পর জনবলকে অব্যাহতি দেওয়া হয়নি। বরং এই জনবল স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন্য প্রকল্পে স্থানান্তর করেছে এলজিইডি। প্রকল্প প্রস্তাব, একনেক, পরিকল্পনা ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অমান্য করে এই কাজ করা হয়। এর মাধ্যমে বেতন-ভাতা বাবদ ৪৯ কোটি টাকা অনিয়মিতভাবে পরিশোধ করা হয়।

বাজেট বরাদ্দ ছাড়াই সাপোর্ট ব্যয়ের টাকা দিয়ে এলজিইডির অফিস ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ, বাসভবন নির্মাণ ও মেরামত কাজ করা হয়। এতে প্রায় ১৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়।
যানবাহন পরিচালন ব্যয়ে বরাদ্দ ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও অপ্রয়োজনীয় গাড়ি ব্যবহার দেখিয়ে বিভিন্ন যানবাহনের জ্বালানিতে খরচ করা হয় ১২ কোটি ৫ লাখ টাকা। সংস্থান না থাকলেও ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয়ের ১ কোটি টাকা দিয়ে গাড়ি ক্রয় করে এলজিইডি।

প্রকল্প শেষ হয়ে যাওয়ার পর উদ্বৃত্ত অর্থ কোষাগারে জমা না দিয়ে প্রকল্পের ব্যাংক হিসাবে রাখে এলজিইডি। বিভিন্ন কাজের নামে ব্যাংকে রাখা অর্থ থেকে ৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়।
এলজিইডি চারটি প্রকল্পে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ৯ ম, ১০ম ও ১১তম গ্রেডে ফ্যাসিলিটেটর, অ্যাসিস্ট্যান্ট ফ্যাসিলিটেটর ও কম্পিউটার অপারেটর পদে লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয়। আউটসোর্সিং নীতিমালা লঙ্ঘন করে, নির্ধারিত পদের বাইরে এসব নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব কর্মীর বেতন-ভাতা বাবদ ৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা পরিশোধ করে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম হয়েছে বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে এলজিইডির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (মনিটরিং, অডিট ও প্রকিউরমেন্ট ইউনিট) মজিবুর রহমান সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই নিরীক্ষার সময় ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয়ের টাকার বিষয়ে কোনো নীতিমালা ছিল না। নিরীক্ষা আপত্তির পর থেকে সাপোর্ট ব্যয়ের টাকা কোষাগারে জমা দেওয়া হচ্ছে। এসব নিরীক্ষা আপত্তি নিষ্পত্তির কাজ চলছে।’

চলতি বছরের ৩ মার্চ ‘ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয় বাবদ বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়–সংক্রান্ত নীতিমালা, ২০২২’ জারি করে স্থানীয় সরকার বিভাগ।

মূলত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় এলজিইডির বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প ও কর্মসূচির পূর্তকাজ বাস্তবায়নে ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয় বাবদ বরাদ্দ করা অর্থ খরচের জন্য এই নীতিমালা করা হয়। তবে এলজিইডি এখন অন্য ক্ষেত্রেও এই নীতিমালা অনুসরণ করছে।

এলজিইডি বর্তমানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পাঁচটি প্রকল্প ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। শিক্ষা অবকাঠামো উন্নয়নের প্রকল্প ও কর্মসূচি হলো—চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৪), চাহিদাভিত্তিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প (১ম পর্যায়), চাহিদাভিত্তিক নতুন জাতীয়করণকৃত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প (১ম পর্যায়), ঢাকা মহানগরী ও পূর্বাচলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন ও অবকাঠামো উন্নয়নসহ দৃষ্টিনন্দনকরণ প্রকল্প, রিচিং আউট অব স্কুল চিলড্রেন (২য় পর্যায়)।

প্রকল্প ৫টিতে মোট বরাদ্দ ২৬ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা। এই পাঁচটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) ২ শতাংশ হারে ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয় ধরা আছে।

নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয় বাবদ প্রাপ্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে। সাপোর্ট ব্যয়ের বিষয়ে এলজিইডির পরিচালন বাজেটের আওতায় ‘অবকাঠামো ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম’ নামে বিশেষ কার্যক্রম সৃজন করে অর্থ বরাদ্দের প্রাক্কলন করতে হবে। ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয়ের টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের অনুমোদন নিয়ে এলজিইডির প্রধান কার্যালয়ের অধীনে আলাদা অর্থনৈতিক কোডভিত্তিক বরাদ্দ দেওয়া হবে। এই বরাদ্দের অর্থ সাধারণ কার্যক্রমের মতোই হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ের মাধ্যমে ব্যয় করতে হবে।

যেসব খাতে ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয়ের টাকা খরচ করা যাবে, তার মধ্যে রয়েছে—কাজ তদারকির জন্য নিয়োগ করা আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগকৃত জনবলের বেতন পরিশোধ, শ্রমিক মজুরি, মুদ্রণ ও মনিহারি ব্যয়, পরামর্শক ব্যয়, প্রচার ও বিজ্ঞাপন ব্যয়, সম্মানী, ভ্রমণ ব্যয়।