বিএসএমএমইউয়ের সমাবর্তনে অব্যবস্থাপনা, ভুলে ভরা স্মরণিকা

ছবি: সংগৃহীত

সমাবর্তন স্মরণিকা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) কর্তৃপক্ষকে। শতাধিক ভুলের এ স্মরণিকা বিতরণ বন্ধ রাখা হয়েছে। অন্যদিকে সমাবর্তনের অব্যবস্থাপনাও চিকিৎসকেরা ভুলতে পারছেন না।

১৩ মার্চ রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের উল্টো দিকের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কনভেনশন সেন্টারে আয়োজিত সমাবর্তন অনুষ্ঠান ছিল অব্যবস্থাপনায় ভরা। ১০ জনের বেশি জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ও চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেছেন, চতুর্থ সমাবর্তন অনুষ্ঠানের বিশৃঙ্খলা ও ভুলে ভরা স্মরণিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।

ছবি: সংগৃহীত
সমাবর্তনের দিন বিকেলেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চিকিৎসকেরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। একজন চিকিৎসক লিখেছিলেন, ‘আপনারা সমাবর্তনের কোন কাজটা ঠিকমতো করতে পেরেছেন? আপনাদের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত বা অডিট হওয়া উচিত।’ একজন চিকিৎসকের পোস্ট ছিল, ‘সমাবর্তনের সঙ্গে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত ছিল, সবার শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।’

বিএসএমএমইউর চতুর্থ সমাবর্তনে নিবন্ধন করেছিলেন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পাওয়া ৩ হাজার ৬০০ জন। তাঁদের মধ্যে ৩ হাজারের বেশি ছিলেন চিকিৎসক। বাকিরা নার্স। তাঁরা প্রত্যেকে ৫ হাজার টাকা দিয়ে সমাবর্তনের জন্য নিবন্ধন করেছিলেন। নিবন্ধন বাবদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পেয়েছে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এ ছাড়া সনদের জন্য প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে দিতে হয় ৩ হাজার টাকা করে।

ছবি: সংগৃহীত

সমাবর্তনের দিন বিকেলেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চিকিৎসকেরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। একজন চিকিৎসক লিখেছিলেন, ‘আপনারা সমাবর্তনের কোন কাজটা ঠিকমতো করতে পেরেছেন? আপনাদের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত বা অডিট হওয়া উচিত।’ অন্য একজনের পোস্ট ছিল, ‘কোন জিনিসটা ঠিকমতো করেছেন আপনারা? ঠান্ডা বিরিয়ানি, প্লাস্টিকের চেয়ারে বসার ব্যবস্থা, অ্যাকোম্পানিকে (বাবা, মা, স্বামী বা স্ত্রী) রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা, ছবি তোলার মতো কোনো সুনির্দিষ্ট জায়গাও নেই।’ কেউ লিখেছেন, ‘নিকৃষ্ট ব্যবস্থাপনা ও নিকৃষ্ট সমাবর্তন।’ অন্য একজন চিকিৎসকের পোস্ট ছিল, ‘আপনাদের লজ্জা বলে কিছু নেই। সমাবর্তনের সঙ্গে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত ছিল, সবার শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।’

তাঁরা চিকিৎসকদের নাম ও ছবি যেভাবে পেয়েছেন, সেভাবেই ছেপেছেন। ছবি ও নাম ঠিক করার মতো যথেষ্ট সময় কমিটি পায়নি।
এস এম ইয়ার-ই-মাহবুব, সমাবর্তনের প্রকাশনা ও মুদ্রণ উপকমিটির সদস্যসচিব,কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক

কনভেনশন সেন্টারে মূল মিলনায়তনে বসার ব্যবস্থা ছিল সর্বোচ্চ ৮০০ জনের। শিক্ষার্থী ও আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন ৬ হাজার। বিএসএমএমইউর স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের একজন অধ্যাপক প্রথম আলোকে বলেছেন, তিনি সমাবর্তন স্থানে ঢুকতে পারেননি। সমাবর্তনে নিবন্ধন করা একজন ক্যানসার চিকিৎসক বলেছেন, তিনিসহ অনেক চিকিৎসক খাবার পাননি। একাধিক অধ্যাপক বলেছেন, চেয়ার ছোড়াছুড়ি ও ধস্তাধস্তির কারণে তাঁরা সভাস্থান ছেড়ে চলে আসেন। চিকিৎসকদের বড় অংশ ক্ষুব্ধ হয়েছেন স্মরণিকায় থাকা ভুলের কারণে।

শতাধিক ভুল, বিকৃত ছবি

২০৮ পৃষ্ঠার স্মরণিকার সিংহভাগজুড়ে আছে সমাবর্তনে নিবন্ধনকৃত স্নাতকোত্তর চিকিৎসক ও নার্সদের ছবির পাশাপাশি নাম, বিভাগ ও পাসের বছর। ৫৯ পৃষ্ঠায় একজন নারী চিকিৎসকের ছবির পাশে পরিচয় হিসেবে বলা হয়েছে মো. ফার্মাকোলজি। ৬১ পৃষ্ঠায় আরও একজন নারীর ছবির পাশে বলা হয়েছে মো. মাইক্রোবায়োলজি।

৮৪ পৃষ্ঠায় ভুল আছে ১২টি। ছবির সঙ্গে নাম অথবা বিভাগের অথবা কোন সালে পাস, তার কোনো ঠিক নেই। ওই পৃষ্ঠায় একজন পুরুষ চিকিৎসকের ছবির পরিচয়ে ছাপা হয়েছে শর্মিষ্ঠা ঘোষাল। একজন নারী চিকিৎসককে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে উজ্জ্বল কুমার ঘোষ হিসেবে।

২০৮ পৃষ্ঠার স্মরণিকায় আছে নানা ধরনের ভুল
ছবি: সংগৃহীত

তবে সবচেয়ে আলোচনা হচ্ছে ৮৫ পৃষ্ঠা নিয়ে। এই পৃষ্ঠায় নারী ও পুরুষ ২৩ জন চিকিৎসকের ছবি ছাপা হয়েছে। তাঁদের প্রত্যেকের নাম মো. রিফাত উদ্দিন তারেক বলে ছাপা হয়েছে। প্রত্যেকে অ্যানেসথেসিওলজি থেকে ডিগ্রি নিয়েছেন। এ রকম ভুলের সংখ্যা ১০৫ বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

তবে ভুল আরও আছে। স্মরণিকার পৃষ্ঠা নম্বর কোথাও বাংলা হরফে, কোথাও ইংরেজিতে। কোনো পৃষ্ঠায় নম্বর নেই। অধিকাংশ পৃষ্ঠায় ২৪টি করে ছবি ছাপা হয়েছে। কোনো কোনো পৃষ্ঠায় ছবির সংখ্যা ৫৭ বা ৬৪। এসব পৃষ্ঠার ছবি আকারে ছোট, বিকৃত। এ রকম ১৬৯ জন চিকিৎসকের বিকৃত ছবি স্মরণিকায় স্থান পেয়েছে।

স্মরণিকার শেষ আট পৃষ্ঠায় ৫১টি ছবি ছাপা হয়েছে অপ্রাসঙ্গিকভাবে। এসব ছবির সঙ্গে সমাবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের কোনো মিল নেই। অন্যদিকে প্রতিটি ছবিতে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. শারফুদ্দিন আহমেদ। এ ছাড়া মলাটসহ শুরুর দিকে উপাচার্যের আরও চারটি ছবি ছাপা হয়েছে।

সমাবর্তন স্মরণিকা সম্পাদনা করেছেন কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও সমাবর্তনের প্রকাশনা ও মুদ্রণ উপকমিটির সদস্যসচিব এস এম ইয়ার-ই-মাহবুব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা চিকিৎসকদের নাম ও ছবি যেভাবে পেয়েছেন, সেভাবেই ছেপেছেন। ছবি ও নাম ঠিক করার মতো যথেষ্ট সময় কমিটি পায়নি। এত ভুলের দায়িত্ব কার? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ভুলের দায় বর্তায় প্রকাশনা কমিটিসহ পুরো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের।’

চৌরাস্তার প্রলাপ

সমাবর্তন অনুষ্ঠানকে বর্ণাঢ্য করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নানা ধরনের ব্যানার, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড লাগানো হয়। কিছু প্ল্যাকার্ডে ভুল বানানসহ বেশ কিছু অসংলগ্ন বাক্য চোখে পড়ে। সমাবর্তনে আসা চিকিৎসকেরা তা ফেসবুকে দিয়ে দেন। এর মধ্যে একটিতে ছিল, ৪র্থ সমাবর্তন সব হারিয়ে আমর শুধু দেবার পালা; অন্য একটিতে ছিল, ৪র্থ সমাবর্তন সফলতার গল্প পড়োরাকারণতা; ৪র্থ সমাবর্তন কোটি বাঙালির ভালোবাসা কাঙ্গাল আমি, আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারব। একজন অধ্যাপক বলেছেন, এগুলো চৌরাস্তার প্রলাপ ছাড়া কিছু নয়।

এত বড় ভুল লেখা প্ল্যাকার্ড সমাবর্তনকে ঘিরে কারা লাগাল, তা কেউ বলতে পারছেন না। এসব কাজের জন্য প্রচার কমিটি ছিল। কমিটির প্রধান ও বিএসএমএমইউর ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক দেবতোষ পাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তারা সময়ের অভাবে কাজটি করেনি।’ তাহলে কাজটি করল কারা, এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রচার কমিটির সভাপতি বলেন, ‘আমরা বিব্রত বোধ করছি। বিষয়টি অনুসন্ধান করছি।’

ছবি: সংগৃহীত

সমাবর্তন অনুষ্ঠান আয়োজন যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ-উত্তেজনা থাকে। এমডি-এমএসডিগ্রিধারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, যাঁদের ছবি বা নাম ভুলভাবে অথবা বিকৃতভাবে ছাপা হয়েছে, তাঁরা সবাই বিব্রত বোধ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো জ্যেষ্ঠ শিক্ষকও এসব বিষয়কে তাঁদের মানসম্মানের জন্য হানিকর বলে মনে করছেন।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. শারফুদ্দিন আহমেদ এর মধ্যে রাজনীতি ও ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে নয়। বিএনপি-জামায়াতের কেউ কেউ সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্ঘাতমূলক কাজ করে থাকতে পারে। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের চেয়ারে বসতে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা বর্তমান প্রশাসনকে হেয় করার জন্য জেনেশুনে ভুল করে থাকতে পারে। আমরা খতিয়ে দেখছি।’