আগামী বাংলাদেশের ১০ করণীয়

বিআইডিএস আয়োজিত আবদুল গফুর স্মৃতিস্মারক গণবক্তৃতা অনুষ্ঠানে (বাঁ থেকে) প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন, জাতিসংঘের অর্থনীতি ও সামাজিক বিষয় বিভাগের উন্নয়ন গবেষণা দপ্তরের সাবেক প্রধান নজরুল ইসলাম, সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো রওনক জাহান ও বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক কাজী ইকবাল। গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিআইডিএস কার্যালয়েছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশের উন্নয়নের পরবর্তী ধাপের জন্য ১০টি করণীয় সুপারিশ করেছেন জাতিসংঘের অর্থনীতি ও সামাজিক বিষয় বিভাগের উন্নয়ন গবেষণা দপ্তরের সাবেক প্রধান নজরুল ইসলাম। এই ১০ সুপারিশ উত্থাপনের সময় বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এতকালের উন্নয়ন প্রয়াসের ছেদ টানতে হবে। ভবিষ্যতের উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে অতীত উন্নয়ন প্রয়াসের মতো ভাবা হলে তা উদ্যোগের ক্ষেত্রে ঘাটতি তৈরি করতে পারে।

গতকাল বুধবার বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ‘আবদুল গফুর স্মৃতিস্মারক গণবক্তৃতা ২০২৪’ দেন নজরুল ইসলাম। তাঁর বক্তৃতার বিষয়: ‘আগামী বাংলাদেশের জন্য ১০ করণীয়’। এ বিষয়ে বিআইডিএস প্রকাশিত পুস্তকে তিনি বাংলাদেশের উন্নয়নের দ্বিতীয় পর্বে এসব বিষয় বাস্তবায়নের সুপারিশ করেন।

আগারগাঁওয়ে বিআইডিএস মিলনায়তনে এই অনুষ্ঠান হয়। এতে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষকেরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন। নজরুল ইসলাম বর্তমানে জাপানের এশিয়ান গ্রোথ ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন।

অতীতের উন্নয়নের কিছু খারাপ ফল আছে। যেমন শিল্পায়নের ফলে পরিবেশদূষণ হয়েছে। বৈষম্য বেড়েছে। তাই নতুন পথে চলতে হবে। তা না ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হওয়া কঠিন হতে পারে।
নজরুল ইসলাম, অর্থনীতিবিদ

নজরুল ইসলাম তাঁর বক্তৃতায় যে ১০টি করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ করেছেন, সেগুলো হলো: অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস; সুশাসন অর্জন; গণতন্ত্রের মানোন্নয়ন ও আনুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থার প্রবর্তন; পরিবেশ রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা; গ্রাম পরিষদ গঠন; ভৌগোলিক বৈষম্যের অবসান; সামাজিক সংহতি বৃদ্ধি; নারী, শিশু, তরুণ ও বৃদ্ধদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ প্রদান; সর্বজনীন সামরিক শিক্ষার প্রবর্তন; সার্বভৌমত্ব শক্তিশালীকরণ ও নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতির অনুসরণ।

অর্থনীতিবিদ নজরুল ইসলাম বলেন, অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানোর জন্য সুশাসন প্রয়োজন। আবার যদি অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস পায়, তাহলে সুশাসন অর্জন সহজ হয়। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ অনেক চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু আমরা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। বিগত কয়েকটি নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তাই আনুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থায় যাওয়া প্রয়োজন।

১০ করণীয় সম্পর্কে বলতে গিয়ে নজরুল ইসলাম ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, অতীতের উন্নয়নের কিছু খারাপ ফল আছে। যেমন শিল্পায়নের ফলে পরিবেশদূষণ হয়েছে। বৈষম্য বেড়েছে। তাই নতুন পথে চলতে হবে। তা না ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হওয়া কঠিন হতে পারে।

বৈষম্য বেড়েছে

নজরুল ইসলাম তাঁর বক্তৃতায় সবার ওপরে স্থান দিয়েছেন অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাসকে। তিনি বলেন, ‘সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, গিনি সহগে বৈষম্যের সূচক দশমিক ৫ শতাংশের বেশি হয়েছে। এর মানে, বৈষম্য গভীর হয়েছে। এই বৈষম্যের কারণে আমরা যেন মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে না পড়ি। অর্থনৈতিক বৈষম্য রাজনীতিতে প্রভাব ফেলে। কারণ, রাজনীতি এখন একশ্রেণির প্রভাবশালীর করায়ত্ত হয়েছে। আমরা অশুভ চক্রে উপনীত হয়েছি।’

বৈষম্য কমানোর জন্য তিনি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মজুরি বৃদ্ধির পরামর্শ দেন।

রাজনীতি উন্নত হলে প্রশাসন উন্নত হবে

‘এ দেশে সুশাসন নিয়ে প্রশ্ন আছে’ বলে মন্তব্য করেন নজরুল ইসলাম। তিনি তাঁর বক্তৃতায় সুশাসন না বলে ‘পরিশাসন’ শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব উন্নত হলে প্রশাসন উন্নত হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব খারাপ হলে প্রশাসন আরও খারাপ হয়।

নজরুল ইসলাম মনে করেন, সরকারি কেনাকাটার প্রক্রিয়ায় অর্থ বেসরকারি খাতে চলে যায়। সরকারি প্রকল্পের ব্যয় বাড়ে। ঠিকাদারেরা বেশি অর্থ নিয়ে যায়। এই টাকা অনেক ক্ষেত্রে বিদেশে চলে যায়। আমলা-ব্যবসায়ী যোগসাজশে এই কাজ হয়। আবার এই শ্রেণির হাতে টাকা যায়, ফলে সমাজে একধরনের আয়বৈষম্য সৃষ্টি হয়।

নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন আছে

এ দেশের গণতন্ত্র নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে। নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্নের মধ্যে পড়েছি—এমন মত দেন নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, কয়েকবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে। পরে বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়। এই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন আছে যে তা কতটা ভালো হয়েছে, কতটা অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়েছে।

নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা এখনো একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থায় পৌঁছাতে পারিনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাকি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন—এ বিষয়ে আর এক জায়গায় পৌঁছাতে পারব বলে মনে হয় না।’ তাঁর মতে, যে দল জেতে, সে-ই সবকিছু পায়। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন হওয়া উচিত। সংসদ সদস্যরা এখন রাস্তাঘাট বানানোর কাজ করেন। সংসদে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেন না। তাই আনুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থায় যাওয়া উচিত।

প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়ে গেছে: রেহমান সোবহান

অনুষ্ঠানে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, সবাই একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করে। কিন্তু এখন নির্বাচন ও জাতীয় সংসদের চরিত্র পাল্টে গেছে। ব্যবসায়ীরা নির্বাচনে অংশগ্রহণকে ব্যবসার সুযোগ হিসেবে দেখেন। তাঁরা সংসদে গিয়ে নিজেদের স্বার্থে কথা বলেন। দুই জাতীয় নির্বাচনের মধ্যকার সময়ে তাঁদের সম্পদ কয়েক গুণ বেড়ে যায়।

প্রতিষ্ঠানগুলোও দুর্বল হয়ে গেছে বলে মনে করেন রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সবার জন্য একই রকম কার্যক্রম পরিচালনা করে না। থানার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আগে দেখেন, কার কী পরিচয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণখেলাপিদের প্রতি সমান আচরণ করে না।

নজরুল ইসলামের ১০টি করণীয় সুপারিশ সম্পর্কে রেহমান সোবহান বলেন, দেখতে হবে, এসব সুপারিশ সমাজের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় কতটা কার্যকর হবে। তা বিবেচনায় আনতে হবে।

অন্যরা যা বললেন

নজরুল ইসলামের গণবক্তৃতার ওপর সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান ও বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক কাজী ইকবাল বক্তব্য দেন।

রওনক জাহান বলেন, আনুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত। সুশাসন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘প্রশাসনের দলীয়করণ এখন বড় ইস্যু। প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো কাজ করছে না, আমলাদের রাজনীতিকীকরণ হয়েছে। এ দুটি ইস্যু ঠিক না হলে সুশাসন নিয়ে বেশি দুর এগোতে পারব না। কখনো কখনো রাজনীতিবিদেরা অসহায় হয়ে যান। তাঁরা আমলাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যান।’

রওনক জাহান আরও বলেন, দেশে রাজনৈতিক বিভাজন আছে। তাই সামাজিক সংহতির কথা বিবেচনা করে বিষয়টি চিন্তায় আনতে হবে।

কাজী ইকবাল বলেন, তৈরি পোশাক ও প্রবাসী আয়—এই দুটো খাতে নিম্ন উৎপাদনশীলতা আছে। উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। উপকূলীয় ও চরাঞ্চলে এক কোটি লোক বসবাস করে। তাদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। আবার শিক্ষা খাতে বড় ধরনের ঘাটতি আছে।

আনুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলেন, বাংলাদেশে এটি কতটা কার্যকর হবে, তা খতিয়ে দেখা দরকার। আবার সরকারি বিনিয়োগ কতটা অপচয় হয়, তা–ও দেখতে হবে।

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন অর্থনীতিবিদ আবদুস সাত্তার মণ্ডল, সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ প্রমুখ।