অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর
ইউরোপ–জাপানের মতো দক্ষ শ্রমবাজারে জোর
প্রবাসী আয় বেড়েছে ২৪%।
সরকারি ব্যবস্থাপনায় কর্মী পাঠানো বেড়েছে ৪%।
বিমানবন্দরে প্রবাসী লাউঞ্জ স্থাপন। ৩০% ছাড়ে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার।
প্রবাসী হাসপাতাল চালুর পরিকল্পনা।
বিদেশে কর্মী পাঠানো দুই বছর ধরে কমতির দিকে থাকলেও বেড়েছে প্রবাসী আয়। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় এসেছে গত অর্থবছরে। প্রবাসীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে জাপান-ইউরোপের মতো দেশে দক্ষ শ্রমবাজারে কর্মী পাঠানোর দিকে জোর দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিদেশের চাহিদা পূরণে তৈরি করা হচ্ছে দক্ষ কর্মী।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, অদক্ষ কর্মীর বাজার সংকুচিত হয়ে আসছে। এর প্রভাব পড়েছে বিদেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রেও। এই পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার বেশি বেতনের শ্রমবাজারে কর্মী পাঠাতে উদ্যোগ নিয়েছে।
এরই মধ্যে ইতালির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশের সঙ্গে চুক্তি হবে। জাপানের সঙ্গেও নতুন করে একটি চুক্তি হয়েছে। উন্নত এসব দেশে দক্ষ কর্মীর চাহিদা বাড়ছে। আগামী পাঁচ বছরে জাপানে এক লাখ কর্মী পাঠানোর লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। ইতালি ও জাপানের ভাষা শিক্ষার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বাড়ানো হচ্ছে দেশে।
অভিবাসন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অতীতে বেশি হারে কর্মী পাঠানো নিয়ে নানা অভিযোগ আছে। অনেক কর্মী বিদেশে গিয়ে কাজ পান না, অবৈধ হয়ে পড়েন। পুলিশের হাতে আটক হয়ে দেশে ফিরে আসেন তাঁরা। এ ছাড়া অদক্ষ কর্মী পাঠানোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন চক্র কাজ করে। বিপুল পরিমাণ টাকা দিয়েও অনেক কর্মী এসব চক্রের হাতে প্রতারিত হন।
দীর্ঘ সময় ধরে বিদেশে কর্মসংস্থান মূলত মধ্যপ্রাচ্যের অদক্ষ কর্মী পাঠানোর ওপর নির্ভরশীল। মধ্যপ্রাচ্যে একজন কর্মী মাসে গড়ে যে বেতন পান, তার চেয়ে তিন থেকে চার গুণ আয় করা যায় জাপান বা ইউরোপের দেশগুলোতে। মধ্যপ্রাচ্যেও চাহিদা কমছে অদক্ষ কর্মীর, তারা দক্ষ কর্মী চায়। বৃহত্তম শ্রমবাজার সৌদি আরবে অদক্ষ কর্মীর চাহিদা কমে এসেছে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার আরব আমিরাতে কর্মী পাঠানো বন্ধ আছে। এরপরে শীর্ষে থাকা ওমানের বাজারও বন্ধ। গত বছরের জুন থেকে বন্ধ হয়ে আছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এসব বাজার দ্রুত চালু করতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে।
সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় যে পরিমাণ কর্মী পাঠানো হচ্ছে, চাহিদা তার চেয়ে অনেক বেশি। ইউরোপে কর্মী পাঠানোর সম্ভাবনাও তেমন কাজে লাগছে না দক্ষ কর্মীর অভাবে। তাই সরকার দক্ষ কর্মী বাড়াতে পারলে অভিবাসন খাতে নতুন গতির সঞ্চার হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, ২০২২ সালে বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে গেছেন ১১ লাখের বেশি কর্মী। ২০২৩ সালে গেছেন ১৩ লাখ কর্মী। আর গত বছর গেছেন ১০ লাখ কর্মী। এ বছরের প্রথম ৭ মাসে গেছেন ৫ লাখ ৮৫ হাজার কর্মী। তবে প্রবাসী আয় বেড়েছে আগের চেয়ে। গত অর্থবছরে (২০২৪-২৫) ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি প্রবাসী আয় এসেছে, যা আগের বছরের চেয়ে ২৪ শতাংশ বেশি।
অবশ্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিনা খরচে কর্মী পাঠানো বেড়েছে। গত অর্থবছরে (২০২৪-২৫) সরকারি এজেন্সি বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (বোয়েসেল) বিভিন্ন দেশে ১৬ হাজার ৬৬ জন কর্মী পাঠিয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৪ শতাংশ বেশি।
জুলাই যোদ্ধাদের সম্মাননা
ঝুঁকি আছে জেনেও গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষে অবস্থান নিয়ে গত বছর বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ করেছেন প্রবাসীরা। এর মধ্যে আরব আমিরাতে পুলিশের হাতে আটক হন অনেকে। তাঁদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার অনুরোধে তাঁদের সাধারণ ক্ষমা করে আরব আমিরাত। আরব আমিরাত থেকে ১৮৮ জন ও সৌদি আরব থেকে ১২ জন মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে আসেন। ছাত্র-জনতার জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান স্মরণে রেমিট্যান্স যোদ্ধা দিবস উদ্যাপন অনুষ্ঠান করা হয় ২ আগস্ট। এতে দেশে ফেরত আসা প্রবাসীদের বিশেষ সম্মাননা জানানো হয়।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় বলছে, আরব আমিরাত থেকে ফিরে আসা ১৮৮ জন কর্মীর প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে ৯৪ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা দিয়েছে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া কাউন্সেলিং ও আর্থিক প্রণোদনা হিসেবে প্রত্যেককে ১৩ হাজার ৫০০ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। যাঁরা আবার বিদেশে যেতে চান, তাঁদের ব্রুনেই পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্থানীয়ভাবে পুনর্বাসনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যাঁরা পুনর্বাসন ঋণের আবেদন করেছেন, তাঁদের মধ্য থেকে ১৪ জনকে ৮৬ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক। আরও ১২ জনের ঋণ কার্যক্রম চলমান।
নতুন নতুন শ্রমবাজারের পথে
গত বছর মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ার কারণে সব প্রক্রিয়া শেষ করেও যেতে পারেননি ১৫ হাজার কর্মী। অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরের কার্যক্রম নিয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ে ৮ হাজার কর্মী পাঠাতে মালয়েশিয়ার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। নামমাত্র খরচে এ কার্যক্রম নিয়েছে বোয়েসেল। এ ছাড়া সর্বোচ্চ পর্যায়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পর নতুন শ্রমিকদের জন্য মালয়েশিয়ার বাজার উন্মুক্ত করে দেওয়ার প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়েছে।
নিরাপদ ও বৈধ অভিবাসন সম্প্রসারণ করতে প্রথমবারের মতো সৌদি আরবের সঙ্গে একটি চুক্তি করার কথা রয়েছে আগামী সেপ্টেম্বরে। সৌদিপ্রবাসীদের সমস্যার সমাধানে একটি যৌথ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে জাপানে পাঁচ লাখের বেশি কর্মী পাঠাতে জাপান সেল গঠন করা হয়েছে। আগে জাপানে শ্রমিক পাঠাতে তিনটি খাতে দক্ষতার পরীক্ষা হতো, এটি পাঁচটি খাতে উন্নীত করা হয়েছে। দক্ষ শ্রমিক প্রশিক্ষণ ও সনদের বিষয়ে জাপানের তিনটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাদা করে তিনটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। মৌসুমি কর্মী পাঠাতে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি প্রদেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে এবং কর্মী পাঠানো শুরু হয়েছে। আরও দুটি সমঝোতা স্মারক সই হচ্ছে। কর্মী পাঠাতে বাংলাদেশ ও ইতালির মধ্যে অভিবাসনবিষয়ক সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।
বন্ধ থাকা শ্রমবাজার ইরাকে কর্মী পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আগামী সেপ্টেম্বরে এ–সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক সইয়ের জন্য ইরাকের উচ্চপদস্থ একটি দল বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে। সিঙ্গাপুরে দ্রুত সময়ে লোক পাঠানোর জন্য সত্যায়ন প্রক্রিয়া প্রত্যাহার করা হয়েছে। গায়েনায় চিকিৎসক ও নার্স পাঠানোর কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। ওমান, সার্বিয়া, স্পেন, অস্ট্রিয়া, মাল্টা ও মরিশাসের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
বিদেশে সুরক্ষা ও দেশে প্রশিক্ষণে জোর
বিদেশে প্রবাসী কর্মীদের সুরক্ষায় ও সেবা নিশ্চিত করায় জোর দিয়েছে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য প্রথমবারের মতো মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা চালু হয়েছে। কাতার, ওমান, সৌদি আরব, আরব আমিরাত ও কুয়েতে আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়েছে। সৌদি আরব, জর্ডান ও ওমানে অনিয়মিত নারী শ্রমিকদের নিয়মিত করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জর্ডানে নারী কর্মী ও ওমানে লক্ষাধিক অবৈধ কর্মীকে বৈধ করার প্রক্রিয়া চলছে। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ‘প্রবাসী লাউঞ্জ ও ওয়েটিং লাউঞ্জ’ স্থাপন করা হয়েছে। এতে ৩০ শতাংশ ছাড়ে স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বর্তমানে ৪৪টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (টিটিসি) জাপানি, ইংরেজি, চীনা ও কোরীয় ভাষা কোর্স পরিচালনা করা হচ্ছে। বিএমইটি ও সৌদি আরবের কোম্পানি ‘তাকামোল’–এর মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে গত এক বছরে ১৫টি টিটিসি ও বিআরটিসি ট্রেনিং সেন্টার দক্ষতা পরীক্ষা পরিচালনা করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। টিটিসিতে কেয়ারগিভার প্রশিক্ষণের সুযোগ ছিল না। বিদেশে এর চাহিদা বাড়তে থাকায় এটি যুক্ত করা হয়েছে।
কর্মীর অনলাইন নিবন্ধনে বিগত সরকার একটি বেসরকারি কোম্পানিকে মোবাইল ফোন অ্যাপ সেবার অনুমতি দেয়। বেসরকারি অ্যাপ বন্ধ করে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য একটি সমন্বিত অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের নিজস্ব ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সরাসরি বহির্গমন ছাড়পত্র প্রদান করা হচ্ছে। এতে কর্মীরা অল্প সময় ও কম অভিবাসন খরচে বিদেশ যেতে পারছেন।
অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রামরুর ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক তাসনিম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, নানা চাপের মুখেও মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সিন্ডিকেট তৈরি হতে দেয়নি সরকার। বিদেশে যেতে কর্মী নিবন্ধনের বেসরকারি অ্যাপ সেবাটি বন্ধ করে দিয়েছে। এ দুটি খুবই ইতিবাচক দিক। তবে শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে আসাটা শঙ্কার। তাই শ্রমবাজার সম্প্রসারণ ও কর্মী তৈরির প্রশিক্ষণে আরও বেশি জোর দেওয়া দরকার।