কানাডা, মেক্সিকো ও চীনের ওপর বাড়তি শুল্ক যুক্তরাষ্ট্রের, সুযোগ বাংলাদেশের
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার দুই সপ্তাহের মাথায় কানাডা, মেক্সিকো ও চীন থেকে পণ্য আমদানিতে বাড়তি শুল্ক আরোপ করলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
স্থানীয় সময় গত শনিবার তিন দেশের পণ্য আমদানিতে শুল্ক আরোপ–সংক্রান্ত পৃথক তিনটি নির্বাহী আদেশে ট্রাম্প সই করেন। আদেশ অনুযায়ী, কানাডা ও মেক্সিকোকে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক দিতে হবে। তবে কানাডার জ্বালানি পণ্যে শুল্কহার হবে ১০ শতাংশ। এ ছাড়া চীনের পণ্যে বর্তমান হারের অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ট্রাম্পের এ নির্দেশ মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) থেকে কার্যকর হবে।
বাণিজ্য চুক্তির আওতায় কানাডা ও মেক্সিকো যুক্তরাষ্ট্রে বিনা শুল্কে অথবা স্বল্প শুল্কে পণ্য রপ্তানি করত। ট্রাম্প আগেই বলেছিলেন, তিনি দায়িত্ব নিয়েই কানাডা, মেক্সিকো ও চীনের ওপর শুল্ক আরোপ করবেন। কারণ হিসেবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসন ও মাদক পাচার ঠেকানোকে সামনে এনেছিলেন। আগের ঘোষণা অনুযায়ী তিনি শুল্ক আরোপ করলেন। ট্রাম্পের এ পদক্ষেপ বাণিজ্যযুদ্ধের শঙ্কা তৈরি করেছে। কারণ, কানাডা, মেক্সিকো ও চীন পাল্টা পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছে। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, এসব পদক্ষেপ বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিতে মন্দাভাব ও মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণ হতে পারে।
স্বল্প মেয়াদে বাংলাদেশ ক্রয়াদেশ ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির সুফল পেতে পারে। কম ও মধ্যম দামের পোশাকের ক্রয়াদেশের একটি অংশ চীন থেকে সরে বাংলাদেশে আসবে বলে আশা করা যায়।খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সিপিডি
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করায় বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখছেন এ দেশের অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, বাংলাদেশের পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য খাত বাড়তি ক্রয়াদেশ বা অর্ডার পেতে পারে। বিনিয়োগকারীরা চীন থেকে কারখানা সরিয়ে এখন অন্য দেশে নিতে আগ্রহী হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে গন্তব্যের একটি হতে পারে বাংলাদেশ।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, স্বল্প মেয়াদে বাংলাদেশ ক্রয়াদেশ ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির সুফল পেতে পারে। কম ও মধ্যম দামের পোশাকের ক্রয়াদেশের একটি অংশ চীন থেকে সরে বাংলাদেশে আসবে বলে আশা করা যায়। জাপান, কোরিয়া, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানিকারক চীনা কোম্পানিগুলোও এখন কারখানা অন্য দেশে সরিয়ে নিতে বাধ্য হতে পারে।
গোলাম মোয়াজ্জেম একটি আশঙ্কার কথা বলেন। তাঁর মতে, বাংলাদেশ রপ্তানি খাতে এগিয়ে গিয়েছে বাণিজ্য উদারীকরণের সুযোগ নিয়ে। এখন বড় বাজারগুলো যদি যুক্তরাষ্ট্রের মতো আমদানিতে শুল্ক আরোপ শুরু করে, সংরক্ষণবাদিতা শুরু হবে। এতে দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোরই অসুবিধা হবে।
ট্রাম্পের পদক্ষেপের পাল্টা ব্যবস্থা শুরু হয়ে গেছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো জানিয়েছেন, সাড়ে ১৫ হাজার কোটি কানাডিয়ান ডলার মূল্যের মার্কিন পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবে তাঁর সরকার। প্রথম ধাপ শুরু হবে মঙ্গলবার। দ্বিতীয় ধাপে শুল্ক আরোপ হবে ২১ দিনের মধ্যে।
ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ জারির পরপরই মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লাউদিয়া শেনবাউম ঘোষণা দেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই শুল্ক আরোপের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেবে তাঁর দেশ। শুল্ক আরোপসহ নিজস্ব অন্যান্য পদক্ষেপের মাধ্যমে এ পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মাদক পাচারকারী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মেক্সিকো সরকারের মৈত্রীর অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন, এটা অপবাদ।
ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের এ সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কানাডা ও মেক্সিকো। জাতিসংঘের কমোডিটি ট্রেড স্ট্যাটিস্টিকস ডেটাবেসের তথ্য অনুযায়ী, কানাডার বার্ষিক রপ্তানির ৭৮ শতাংশ ও মেক্সিকোর ৮০ শতাংশ পণ্য রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের মোট আমদানি মাত্র ১৪ শতাংশ কানাডা থেকে ও ১৫ শতাংশ আসে মেক্সিকো থেকে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিকল্প বাজার খোঁজা সহজ হলেও কানাডা ও মেক্সিকোর জন্য তা কঠিন হবে।
চীন যুক্তরাষ্ট্রে বছরে ৪০ হাজার কোটি ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য রপ্তানি করে। চীনা পণ্যে বাড়তি শুল্ক আরোপের নিন্দা জানিয়েছে বেইজিং। চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের পদক্ষেপে চীন ভীষণ অসন্তুষ্ট। তারা দৃঢ়ভাবে এর বিরোধিতা করে। এটি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়মনীতির গুরুতর লঙ্ঘন। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অনুরূপ পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্যারিসভিত্তিক ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং কোম্পানি নাটিক্সিসের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ গ্যারি এনজি বলেন, ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের জবাবে বেইজিং যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানিতে পাল্টা শুল্ক আরোপ করতে পারে। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি সীমিত করতে পারে তারা। এ ছাড়া চীনের বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু প্রতিষ্ঠানের প্রবেশে বিধিনিষেধ দিতে পারে বেইজিং।
চীন, কানাডা ও মেক্সিকো যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বাণিজ্য অংশীদার। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র যত পণ্য আমদানি করেছে, এর ৪০ শতাংশ গেছে এ তিন দেশ থেকে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের এ সিদ্ধান্তে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। এ ছাড়া ট্রাম্পের এ পদক্ষেপ বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা ও ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক জোসেফ স্টিগলিৎজ বলেন, কার্যত সব অর্থনীতিবিদ মনে করেন, শুল্কের প্রভাব যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, পুরো বিশ্বের জন্যও খুব খারাপ হবে। ট্রাম্পের এ পদক্ষেপে প্রায় নিশ্চিতভাবেই মূল্যস্ফীতি বাড়বে।
২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকার সময় চীনের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করেন। জবাবে চীনও মার্কিন পণ্যে শুল্ক আরোপ করে। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে তৈরি হওয়া বাণিজ্য টানাপোড়েন তখন বাণিজ্যযুদ্ধ হিসেবে পরিচিতি পায়।
‘নিজেদের প্রস্তুতিও থাকতে হবে’
একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ প্রায় ৭৬০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১৭ শতাংশের বেশি। দেশটিতে বাংলাদেশ বেশি রপ্তানি করে পোশাক। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে সবচেয়ে এগিয়ে চীন। এরপর ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার অবস্থান।
ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর সময়ে চীন যুক্তরাষ্ট্রে ১ হাজার ৫২২ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৬৭৬ কোটি ডলার। এই রপ্তানি আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কিছুটা কম। তবে গত সেপ্টেম্বর থেকে রপ্তানি আয় বাড়ছে।
বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী পোশাক খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ভিয়েলাটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এম রেজাউল হাসনাত প্রথম আলোকে বলেন, চীন থেকে কিছু ব্যবসা অন্য দেশে যাবে। সে সুযোগ নিতে বাংলাদেশের প্রস্তুতি থাকতে হবে। দেশে ব্যবসা সহজ করতে হবে, গ্যাস-বিদ্যুতের পর্যাপ্ত সরবরাহ দরকার এবং দামও নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। তিনি বলেন, দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব প্রস্তুতিও দরকার। ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে গুণগত মানের পণ্য ও সেবা দিতে না পারলে সুযোগটি নেওয়া যাবে না।