ডাক দিয়ে যায় মহান মে দিবস: জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যাহত! জাগো...
ঠেলাগাড়ির চল ছিল তখন। কাঠের চাকা লাগানো এসব গাড়িতে লোকে স্বল্প দূরত্বে মালামাল আনা-নেওয়ার কাজ করতেন। হাটবাজারেই বেশি দেখা যেত। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের আধা ভাঙা পথ ধরে নানা ধরনের মালামালের বস্তা বোঝাই করে উদোম গায়ের কোনো এক লোক প্রাণপণে টেনে নিয়ে চলেছেন সেই গাড়ি। আমাদের মফস্সল শহরে (বগুড়ার শেরপুর) বাজারের সামনে এসব গাড়ির রাখার জন্য বটগাছের তলায় খানিকটা জায়গাও ছিল। যাঁরা গাড়ি টানতেন, তাঁদের পরনে থাকত খাটো লুঙ্গি। কোমরে গামছা বাঁধা। মালামাল নামিয়ে দিয়ে এসে তাঁরা গামছায় ঘর্মাক্ত শরীর মুছে বসতেন গাছতলায়। হাওয়ায় গা জুড়িয়ে নিতে নিতে গল্পস্বল্প করতেন পাশে বসা তাঁদের মতোই আরেকজনের সঙ্গে।
এসব ছিল প্রতিদিনের চেনা দৃশ্য। কেমন একটা দূরত্বও যেন ছিল তাঁদের সঙ্গে। নেহাত দরকার না পড়লে, অর্থাৎ মালপত্র আনা-নেওয়ার জন্য ঠেলা ভাড়া করতে না হলে সাধারণত অন্য লোকেরা তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা, মেলামেশা করতেন না। বাজারের বড় বড় মহাজনই ছিলেন তাঁদের মজুরিদাতা। বড় রাস্তায় ট্রাকবোঝাই মালামাল এলে তাঁরা তা নামিয়ে গুদামে তুলতেন। এই হলো প্রধান কাজ। বেশভূষার মতোই মলিন জবুথবু চেহারা একেকজনের।
তবে বছরের অন্তত একটি দিনে বদলে যেত তাঁদের এই বাঁধা জগতের জীবনধারা। মরচে ধরা লোহার মতো কঠিন অথচ নিষ্প্রভ মানুষগুলোকেই সেদিন লাগত অন্য রকম। মনে হতো কাউকেই যেন কোনো পরোয়া নেই তাঁদের, অপেক্ষা নেই কোনো কিছুর জন্য। যা হওয়ার তা হয়ে যাবে—এমন একধরনের ভাবাবেগের তাৎক্ষণিকতায় তাঁরা উচ্ছ্বসিত। কী যেন এক উদ্দীপনাতাড়িত। একান্তই নিজের অধিকারের এখতিয়ারে কোনো কিছু পাওয়ার যে অনুভূতি, সেই আনন্দে উল্লসিত মনে হতো তাঁদের। চিৎকার করে তাঁরা কোরাসের মতো কণ্ঠ মেলাতেন স্লোগানে ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’। এগিয়ে যেতেন রাজপথ কাঁপিয়ে।
সেই দিনটি যে ‘মে দিবস’, ওই মিছিল দেখেই আমরা তা বুঝতাম। খররোদে ঝলমলে দিন। বহুদূর থেকেই স্লোগানের আওয়াজ ভেসে আসত। মিছিল দেখতে ছুটে যেতাম মহাসড়কের পাশে (মিছিল তখন দেখার মতোই ছিল বটে)। আমাদের ছোট্ট মফস্সল শহরে কলকারখানা বিশেষ কিছু ছিল না। মজদুর বলতে ওই ঠেলাগাড়ি আর রিকশাচালকেরাই প্রধান। আর কিছু বাসশ্রমিক, হোটেলশ্রমিক, চাতালের (চালকল) শ্রমিক। মে দিবসের মিছিলে তখন কোনো নারীর অংশগ্রহণ দেখা যেত না।
ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে সে সময় এখনকার মতো এত যানবাহনের চলাচল ছিল না। প্রায় নিরিবিলি সেই সড়ক ধরে এগিয়ে আসত এক আগুনরঙা মিছিল। সামনে থাকত ঠেলাগাড়িগুলোর দীর্ঘ সারি। তারপর মাঝে মাঝে রিকশা। রিকশাগুলোর হ্যান্ডেলের সঙ্গে বাঁধা থাকত মাইক। পেছনে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে স্লোগান দিতেন জনাকয়েক। সবার মাথায় বাঁধা লাল শালুর ফেটি। হাতে লাল রঙের ত্রিকোণ নিশান। তার মাঝখানে সাদা রঙের হাতুড়ি-কাস্তে আঁকা। ঠেলাগাড়িতে সেদিন কোনো বোঝা না থাকায় পাকা রাস্তা ধরে গড়গড় করে টেনে নিতেন চালকেরা। ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’, ‘মহান মে দিবস অমর হোক’—এসব স্লোগানে চারদিক প্রকম্পিত। মাঝেমধ্যে খালি গলায় গানও গাওয়া হতো মাইকে। ‘জাগো জাগো জাগো সর্বহারা’ কিংবা ‘জাগো অনশন-বন্দী ওঠো রে যত/ জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যাহত! জাগো...’ সেই স্লোগানের রেশ, সেই গানের সুর হাওয়ায় অনুরণন তুলে এগিয়ে যেত। একেবারেই অন্য রকম সেই মিছিল।
মে দিবসের কথা মনে হলে অতীতের অন্ধকার ফিকে হয়ে স্মৃতির অ্যালবামে স্পন্দিত হয়ে ওঠে শৈশব-কৈশোরে দেখা সেই রক্তিম মিছিল। এই অন্য রকম মিছিল কেন পথে নামত মে মাসের প্রথম দিনে, তখন বুঝিনি। মিছিলের সেই আবেগতাড়িত লোকগুলোকে পরদিন দেখতাম আবার আগের মতোই নিষ্প্রভ, মালামালবোঝাই গাড়ি টানছেন ধুঁকতে ধুঁকতে। আগের দিনের সেই মিছিল এবং আরও যা কিছু, সবই যেন গাছ থেকে ঝরে পড়া পাতার মতো। তার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক নেই পরের দিনগুলোর। অথবা যেন তা ছিল স্বপ্নদৃশ্যের কোনো অলীক উৎসবের মতো। কিংবা বাস্তবিকই সেই দীপ্ত দিনের কোনো গভীর অভিঘাত গোপনে কোথাও কিছু নাড়াচাড়া দিয়ে দিয়ে যেত, যার বাহ্যিক প্রকাশ ছিল আমার অজানা।
আসলে হয়তো সে রকমই কিছু ঘটে। অনেক দিন ধরে পাথরের ওপর মাটির কলস রাখতে রাখতে কঠিন পাথরও ক্ষয়ে যায়। শতাব্দীর অধিককাল ধরে মে মাসের এই দিনটির উদ্দীপনাময় উদ্যাপন তেমনি করেই হয়তো তার অন্তর্গত শক্তির অভিঘাতে সমাজ ও জনমানসের ভেতরের নতুন ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছে। একটু একটু করে নাড়িয়ে দিয়েছে কোনো প্রবল পরাক্রমের জমাট-নিরেট আদিম পাথর।
শ্রম মানুষের জীবিকা নির্বাহের অনিবার্য শর্ত। আর্থিক মানদণ্ডেই তার একমাত্র ও সর্বশেষ মূল্যায়ন কি না, সে তর্ক থাক। কিন্তু শোষণের সংযোগও এই শ্রম থেকেই ছড়িয়ে গেছে নানাভাবে—উদ্ভিদের শিকড়ের মতো। শ্রমের মূল্য অর্থের পরিমাপেই যখন শোধ করার সিদ্ধান্ত স্বতঃসিদ্ধ বলে স্বীকৃত, তখন সংগতভাবেই এসে যায় সেই মূল্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তার প্রশ্ন। জীবনধারণের নিমিত্তেই যেহেতু শ্রম, সে কারণে শ্রম যেন জীবনবিনাশী না হয় এবং শ্রমের মূল্য জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য পর্যাপ্ত হয়, তারও নিশ্চয়তা বিধান করা প্রয়োজন। কিন্তু কে তা করবে? সেটাই ছিল মূল প্রশ্ন, সেখানেই অধিকার আদায়ের সংগ্রাম শুরু।
শ্রমের সঙ্গে উৎপাদন ও মুনাফা বিষয়টি সমন্বিত। আরও নানা অনুষঙ্গ আছে। তবে মোদ্দাকথা হলো, শ্রম যাঁরা কিনতে চান, তাঁরা গোড়া থেকেই চাইলেন মূল্য কমিয়ে রাখতে। তাতে মুনাফা বাড়িয়ে তুলতে সুবিধা। এভাবেই তো চলছিল সেই আদ্যিকাল থেকে। আদ্যিকাল বলতে সেই যখন থেকে আদি সমতাভিত্তিক সমাজ ভেঙে ব্যক্তিগত সম্পদ গড়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। তখন থেকেই ভেতরে-ভেতরে কর্কট রোগের মতো বেড়ে উঠছিল অন্যের শ্রম শোষণ করে নিজের সম্পদকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলার প্রক্রিয়া। সমাজের অধিকাংশ সম্পদ মুষ্টিমেয় মানুষের করায়ত্ত হয়েছে। কালের দীর্ঘ পরিক্রমায় বিবর্তনের পথে সমাজ সংগঠনের পরিকাঠামোতেও এসেছে নানা ধরনের পরিবর্তন। তবে উৎপাদনব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় ধনবানদের একচেটিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শ্রমজীবী মানুষেরা তাঁদের অধিকার নিয়ে সচেতন হয়েছেন। যে শ্রম জীবনকে ভেতর থেকে ক্ষয়িষ্ণু করে ফেলে অথচ তার মূল্য হিসেবে যে মজুরি দেওয়া হয়, তা যদি জীবনধারণের ব্যয় মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত না হয়, তাহলে কি সেই মজুরিকে উপযুক্ত বলা সংগত হবে? কোন মানদণ্ডে নির্ধারিত হবে শ্রমের মূল্য বা মজুরি? তারপর আছে সময়ের প্রশ্ন। একজন শ্রমিক, তিনি যে ধরনেরই শ্রম দেন না কেন, দৈনিক কতটা সময় দেবেন জীবিকার শ্রমে? আছে কাজের পরিবেশ ও ধরন নিয়েও প্রশ্ন।
এসব প্রশ্ন যখন বড় হয়ে উঠতে শুরু করেছিল, তখন স্বাভাবিক নিয়মেই তার প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল বিদ্যমান সমাজ অর্থনীতিতে। মানুষ চিরকালই কল্যাণপ্রত্যাশী বটে, কিন্তু সমাজে আত্মদান ব্যতিরেকে, চড়া মূল্যের বিনিময় ছাড়া কল্যাণকর কোনো কিছুর প্রতিষ্ঠা ঘটেনি। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। দীর্ঘদিনের সঞ্চিত ক্ষোভের বারুদের বিস্ফোরণ ঘটেছিল ১৮৮৬ সালের পয়লা মে। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকেরা কাজের মেয়াদ আট ঘণ্টা নির্ধারণ, মজুরি বৃদ্ধি, কাজের পরিবেশ উন্নত করাসহ বিভিন্ন দাবিতে সেদিন ধর্মঘট ডেকে পথে নেমেছিলেন। অত্যন্ত বর্বর কায়দায় দমন করা হয়েছিল সেই ধর্মঘট। তার প্রতিবাদে ৩ মে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছিলেন শ্রমিকেরা। আবার পুলিশি তাণ্ডব। গুলিবর্ষণ। প্রাণ হারিয়েছিলেন ছয়জন শ্রমিক। বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন শ্রমিকেরা। পরদিন আবারও উত্তাল শিকাগোর হে মার্কেট। কারখানামালিকদের লেলিয়ে দেওয়া গুন্ডারা হামলা চালাল প্রতিবাদ সমাবেশে। সেদিন প্রাণ হারালেন আরও চারজন শ্রমিক। গুন্ডাপান্ডাদের তো কিছু হলোই না, উপরন্তু শ্রমিক ধর্মঘট আহ্বানের জন্য শ্রমিকনেতা অগাস্ট স্পাইসকে দেওয়া হলো ফাঁসির আদেশ।
এই ছিল প্রেক্ষাপট। একে কেন্দ্র করে সারা বিশ্বেই শোষিত, নিপীড়িত শ্রমজীবী জনতা বিক্ষোভে সোচ্চার হয়েছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৮৯ সালের ১৪ জুন ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কংগ্রেসে ১ মে শ্রমিক দিবস ঘোষণা করা হয়।
মে দিবসের চেতনা অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে শ্রমিকশ্রেণির সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর রাশিয়া এবং পশ্চিম ইউরোপের দেশ ও আফ্রো-এশিয়ার দেশগুলোয় মে দিবস এক বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে উদ্ভাসিত হয়। মেহনতি মানুষের মুক্তির সংগ্রাম সমাজবিপ্লবের অগ্রযাত্রাকে বেগবান করে তোলে। দেশে দেশে জাতীয় রাজনীতিতে সংযোজিত হয় নতুন মাত্রা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ধনবাদী দেশগুলো তাদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের নীতিকৌশল পরিবর্তন করে। নিজের নিরাপত্তায় বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে জোট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা ছিল বিপন্ন মানবতা ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রক্ষার উদ্যোগের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পরবর্তী পর্যায়ে জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) গঠনের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের অধিকার আইনানুগ স্বীকৃতি লাভ করে। প্রণীত হয় নানা ধরনের আইন ও নীতি।
আজ ১৩৮ বছর পর মে দিবস বিশ্বের মুক্তিকামী মেহনতি জনতার কাছে এক দীপ্ত চেতনাময় সংকল্প ও প্রেরণার উৎসে পরিণত। সেই প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশে দিবসটির তাৎপর্য গভীর ও ব্যাপক। এবার ‘শ্রমিক মালিক গড়ব দেশ, স্মার্ট হবে বাংলাদেশ’—এ প্রতিপাদ্য নিয়ে দিনটি পালিত হচ্ছে।
আমাদের এখানে কর্মসংস্থানের অভাব। শ্রম উদ্বৃত্ত, ফলে সস্তা। সীমিত শিল্পকারখানা। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩ অনুসারে দেশে মোট শ্রমিকের মাত্র ১৭ শতাংশ শিল্পশ্রমিক (৪৫ শতাংশ কৃষিতে, ৩৮ শতাংশ সেবা খাতে)। ন্যূনতম মজুরি নিয়ে তাঁদের সংগ্রাম চলমান। পোশাকশ্রমিকেরা তাঁদের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে আন্দোলন করেন। এখনো শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে আন্দোলন প্রায়ই সংঘাত সংঘর্ষে রক্তাক্ত এবং বেদনাময় হয়ে ওঠে। বিপুল কৃষিশ্রমিক, দিনমজুর, গৃহশ্রমিকদের ক্ষেত্রে সরকারনির্বারিত কোনো ন্যূনতম মজুরি নেই। এ রকম অনেক ক্ষেত্রেই ন্যূনতম মজুরির কোনো পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি। উপরন্তু রয়েছে শিশুশ্রমের সমস্যা।
এসব কারণে শতাব্দী অতিক্রম করেও মে দিবসের চেতনা নিষ্প্রভ হয়নি, বরং দিন দিন তা আরও দীপ্ত, আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির আন্দোলন চলছেই। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে তাঁদের রক্তিম মিছিল। মুক্তির মন্দির সোপানতলে বহু প্রাণের আত্মদানে, বহু মায়ের অশ্রুতে লেখা হয়েছে যে ইতিহাস, তা নিশ্চয়ই সাহস ও সংকল্পে বলীয়ান করে তুলবে মুক্তিকামী মেহনতি জনতাকে।