সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় ধীরগতি

সড়ক দুর্ঘটনা
প্রতীকী ছবি

সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা চালু করেছে সরকার। তবে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রক্রিয়ার গতি কিছুটা ধীর। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পর্যাপ্ত জনবল সৃষ্টি হয়নি। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়টি সেভাবে প্রচারও করা হয়নি। ফলে আবেদনও কম পড়ছে।

সরকার ২০১৮ সালে সড়ক পরিবহন আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের আর্থিক সহায়তার বিধান যুক্ত করে। ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য বিধিমালার প্রজ্ঞাপন জারি হয় গত বছরের ৩ জানুয়ারি। এ পর্যন্ত এক বছরের বেশি সময়ে ১৯৪ জনকে মোট ৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। মূলত গত ১৯ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবার একসঙ্গে ১৬২ জনকে প্রায় সাত কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে এই কার্যক্রম শুরু করেন। এরপর গত প্রায় তিন মাসে আরও ৩২ জনকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।

ক্ষতিপূরণ যে দেওয়া হচ্ছে, তা জানাতে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। আর আবেদন নিষ্পত্তি দ্রুত করতে আরও লোকবল বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
নূর মোহাম্মদ মজুমদার, বিআরটিএর চেয়ারম্যান ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য গঠিত ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ২৪ জনের প্রাণ গেছে। আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৯৫ জন। আইন অনুযায়ী প্রত্যেক নিহত ব্যক্তির পরিবার ও আহত ব্যক্তিরা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যোগ্য।

বিআরটিএর তথ্য ধরলেও হতাহতের চেয়ে ক্ষতিপূরণের আবেদনের সংখ্যা অনেক কম। অবশ্য বেসরকারি হিসাবে হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি।

বিআরটিএর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এখন প্রতি মাসে গড়ে ৭০টি আবেদন পড়ছে। যে গতিতে দেওয়া হচ্ছে, তাতে প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০টির বেশি ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ আবেদনের সংখ্যা কম হওয়ার পরও তা জমে যাচ্ছে। আবেদন বাড়লে আরও জটিলতা তৈরি হবে।

সড়ক পরিবহন ক্ষতিপূরণ বিধিমালা অনুসারে, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা গেলে ভুক্তভোগী ব্যক্তির পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাঁচ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। আর গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গহানি হলে ভুক্তভোগী ব্যক্তি পাবেন তিন লাখ টাকা। আহত কারও চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা না থাকলে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে তিন লাখ টাকা। তবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকলে পাবেন এক লাখ টাকা।

বিআরটিএর চেয়ারম্যান ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য গঠিত ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষতিপূরণ যে দেওয়া হচ্ছে, তা জানাতে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। আর আবেদন নিষ্পত্তি দ্রুত করতে আরও লোকবল বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন

আবেদনের সংখ্যা ও তহবিলের অর্থ

বিআরটিএ সূত্র জানায়, বিধিমালা হওয়ার পর থেকে চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত এক বছরের বেশি সময়ে  ক্ষতিপূরণের ৮৭৯টি আবেদন জমা পড়েছে। স্থায়ী অনুসন্ধান কমিটি তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে ২৭৩টি। আর্থিক সহায়তার চেক দেওয়া হয়েছে ১৯৪টি।

এ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের তহবিলে জমা হয়েছে প্রায় ১২৯ কোটি টাকা। যানবাহনের ট্যাক্স-টোকেন সংগ্রহের সময় মালিকদের কাছ থেকে বিভিন্ন হারে চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে তহবিলে টাকা জমা হচ্ছে।

বিআরটিএর ধারণা, সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ৩০ শতাংশ মানুষ সম্পদশালী। তাঁরা হয়তো ক্ষতিপূরণের আবেদন না–ও করতে পারেন। বাকি ৭০ শতাংশ আবেদন করলে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বছরে ৩০০ কোটি টাকার মতো। কিন্তু যানবাহনের মালিকের কাছ থেকে এখন যে চাঁদা আসছে, তাতে বছরে বড়জোর ১০০ কোটি টাকা উঠতে পারে। ফলে বিধিমালায় উল্লেখ করা অন্যান্য উৎস থেকেও চাঁদা আদায় করতে হবে।

দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের দাবি মীমাংসার জন্য রয়েছে ১২ সদস্যের একটি ট্রাস্টি বোর্ড। বিআরটিএর চেয়ারম্যান পদাধিকারবলে বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিকেরা বোর্ডের সদস্য। বোর্ডের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য লোকবল নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ আছে। ৩৪ জনের জনবল কাঠামোর একটি প্রস্তাব সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে প্রায় এক বছর আগে পাঠানো হয়েছে। তা এখনো অনুমোদিত হয়নি। ফলে বিআরটিএর বর্তমান কর্মকর্তারাই কাজটি করছেন।

দুর্ঘটনার পর ক্ষতিপূরণের বিষয়ে তদন্ত করে সুপারিশের জন্য ১৪ সদস্যের স্থায়ী কমিটি রয়েছে। ঢাকার বাইরে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিআরটিএর সংশ্লিষ্ট সহকারী পরিচালক সদস্যসচিব। পুলিশ, পরিবহনমালিক-শ্রমিক প্রতিনিধিরা সদস্য হিসেবে আছেন।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ২৪ জনের প্রাণ গেছে। আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৯৫ জন। আইন অনুযায়ী প্রত্যেক নিহত ব্যক্তির পরিবার ও আহত ব্যক্তিরা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যোগ্য।

তহবিল যেভাবে গঠন হওয়ার কথা

সড়ক পরিবহন আইনে ক্ষতিপূরণের জন্য গঠিত তহবিলের টাকা কোন কোন খাত থেকে আসবে, তার বিস্তারিত বলা আছে বিধিমালায়। খাতগুলো হলো সরকারের দেওয়া অনুদান, মোটরযানের মালিকের কাছ থেকে তোলা চাঁদা, সড়ক পরিবহন আইনের মাধ্যমে আদায় করা জরিমানার অর্থ, মালিক সমিতি থেকে দেওয়া অনুদান, শ্রমিক সংগঠন বা শ্রমিক ফেডারেশন থেকে দেওয়া অনুদান, অন্য কোনো বৈধ উৎস থেকে পাওয়া অর্থ।

বিআরটিএ সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত শুধু যানবাহনের মালিকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।

বিধিমালা অনুসারে, ট্রাস্টি বোর্ড তহবিলের একটি অংশ লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করতে পারবে। এই অর্থ দিয়ে সড়ক খাতের গবেষণার কথাও বলা হয়েছে। এর কোনো কিছুই এখনো শুরু করতে পারেনি ট্রাস্টি বোর্ড।

বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার তহবিল বাড়ানোর বিষয়ে বলেন, ইতিমধ্যে সড়ক পরিবহন আইনে আদায় করা জরিমানা তহবিলে জমা করার জন্য সরকারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আস্তে আস্তে অন্যান্য খাত থেকে চাঁদা আদায় করা হবে।

আরও পড়ুন

যেভাবে আবেদন

সড়ক আইন অনুসারে, আর্থিক সহায়তা পেতে নির্ধারিত ফরমে দুর্ঘটনার সর্বোচ্চ ৩০ দিনের মধ্যে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করতে হবে। ফলে যেসব দুর্ঘটনায় ৩০ দিন পেরিয়ে গেছে, সেগুলোতে আর আবেদনের সুযোগ নেই। আবেদন দাখিলের দিন থেকে ১০ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন। এই কমিটি ৩০ দিনের মধ্যে আবেদনকারীর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে প্রতিবেদন জমা দেবে।

প্রতিবেদন দাখিলের ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে ট্রাস্টি বোর্ড আবেদনকারীর ব্যাংক হিসাবে ‘প্রাপকের হিসাবে প্রদেয়’ চেকের মাধ্যমে টাকা দেবে। অর্থাৎ দুর্ঘটনার দুই মাসের মধ্যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব।

বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে আবেদন করার আহ্বান জানানো হয়েছে। যাচাই–বাছাইয়ে প্রাপ্য হলে প্রতে৵ককেই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। ধীরে ধীরে যাচাই–বাছাইয়ের সময়ও কমে আসবে।