হেপাটাইটিস প্রতিরোধ হোক পরিবার থেকে

হেপাটাইটিসের প্রথম সংক্রমণ হতে পারে পরিবার থেকে। মা থেকে নবজাতক সন্তানের মধ্যে যেন হেপাটাইটিস না ছড়ায়, তা নিশ্চিত করতে সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি। হেপাটাইটিস রোধে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে স্ক্রিনিংয়ের পাশাপাশি ভ্যাকসিন প্রয়োগ এবং হেপাটাইটিস পরীক্ষায় ব্যাপকভাবে মানুষকে আগ্রহী করতে সরকারি ক্যাম্পেইনের আয়োজন করা দরকার।

গতকাল সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস উপলক্ষে আয়োজিত ‘পরিবার থেকেই শুরু হোক হেপাটাইটিস প্রতিরোধ: টেস্ট করুন, টিকা নিন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ কথাগুলো উঠে আসে। প্রথম আলো ও হেপাটোলজি সোসাইটি ঢাকা বাংলাদেশের উদ্যোগে এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়।

সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সঠিক সময়ে পরীক্ষা ও টিকা গ্রহণের মাধ্যমে হেপাটাইটিস রোগ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব বলে গোলটেবিল বৈঠকে মত দেন বক্তারা।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি ও জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান বলেন, হেপাটাইটিস, হেপাটাইটিস বি এখন প্রতিরোধযোগ্য। সে জন্য পরিবারের দায়িত্ব অনেক। যারা টিকা নেয়নি, তাদের যেন টিকা নিশ্চিত করা হয়। টিকা নিশ্চিত করা গেলে এই রোগকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।

বৈষম্য ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ পরীক্ষায় হেপাটাইটিস বি এবং সি স্ক্রিনিং টেস্ট আইন করে নিষিদ্ধ করেছে। গোলটেবিল আলোচনায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতি বিষয়টি ভেবে দেখার আহ্বান জানান হেপাটোলজি সোসাইটি ঢাকা বাংলাদেশের সভাপতি ও বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. শাহিনুল আলম। তিনি বলেন, বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হেপাটাইটিস আক্রান্ত তরুণদের চাকরি হয় না। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই বৈষম্য রয়েছে।

হেপাটাইটিস রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য নিরসনের আহ্বান জানিয়ে মো. শাহিনুল আলম বলেন, ‘রোগীর সংস্পর্শে এলেই অন্য কেউ আক্রান্ত হবে, এমন ধারণা অমূলক। কারণ, স্বাভাবিক জীবনযাপনে এই রোগ ছড়ায় না। একই প্লেটে খেলে, আক্রান্ত ব্যক্তির কাপড় পরিধান করলে কিংবা হাত মেলালেও এই রোগ ছড়ায় না। কাজেই এ প্রসঙ্গে প্রকৃত ধারণা ও চিকিৎসার উপায় আমাদের ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে।’

হেপাটাইটিস রোগে প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ মারা যান, যা এইডসের চেয়ে বহুগুণ বেশি। এমন মন্তব্য করেন বারডেমের লিভার ও গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের প্রধান ও হেপাটোলজি সোসাইটি ঢাকা বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক মো. গোলাম আযম। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে হেপাটাইটিস রোগ মূলত ভাইরাসের মাধ্যমে ছড়ায়। তবে নন-অ্যালকোহলিক স্টিয়াটোহেপাটাইটিস, মদ্যপানজনিত, ড্রাগ বা অটোইমিউনের কারণেও হেপাটাইটিস হতে পারে। বিশুদ্ধ খাদ্য ও পানি গ্রহণের মাধ্যমে হেপাটাইটিস এ এবং হেপাটাইটিস ই ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।’

জনসচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে মনে করেন মো. গোলাম আযম। তিনি বলেন, এই রোগ নিয়ন্ত্রণে ব্যাপকভাবে টিকা প্রদানের বিকল্প নেই। পাশাপাশি আক্রান্ত পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে সঠিক সময়ে পরীক্ষা করাতে হবে।

অনেক পরিবারে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস থাকলেও পরীক্ষা করাতে অনীহা দেখা যায় বলে উল্লেখ করেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নাজমুন নাহার। তিনি বলেন, ‘আমরা পরিবারগুলোতে একটা ভীতি দেখতে পাই যে তারা বিষয়টি লুকিয়ে রাখতে চায়, যেটা ঠিক নয়। কাজেই সময়মতো পরীক্ষা করানো ও টিকা দেওয়া গেলে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে সফলতা বাড়ানো যাবে।’

হেপাটাইটিস আক্রান্ত মা থেকে নবজাতকের সংক্রমণ প্রতিরোধ ও চিকিৎসার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী।

বাংলাদেশে হেপাটাইটিসের আক্রমণ প্রায় ৪ দশমিক ৬ শতাংশ উল্লেখ করে মোহাম্মদ আলী বলেন, যেসব দেশে হেপাটাইটিসের প্রাদুর্ভাব ২ শতাংশের বেশি, সেসব দেশে নবজাতকের ইমিউনাইজেশন জরুরি। পাশাপাশি হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত গর্ভবতীদের প্রয়োজন বুঝে অ্যান্টিভাইরাল প্রয়োগ জরুরি।

টিকাভীতি ও কুসংস্কার দূর করার প্রতি গুরুত্ব উল্লেখ করে মোহাম্মদ আলী বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের হেপাটাইটিস পরীক্ষা এবং টিকা প্রদানের আওতা বাড়ানো প্রয়োজন। কারণ, গর্ভাবস্থায় মায়েদের পরীক্ষা না করা থাকলে পরবর্তী সন্তানদেরও হেপাটাইটিস বি সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে।

হেপাটাইটিস প্রতিরোধে গণমাধ্যমের সচেতনতা বৃদ্ধির প্রতি গুরুত্বারোপ করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের লিভার বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ। তিনি বলেন, হেপাটাইটিস সম্পর্কিত তথ্য, পরবর্তী চিকিৎসা, টিকা গ্রহণ এবং সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে মানুষকে ব্যাপকভাবে জানাতে হবে। তা না হলে এই রোগ সম্পর্কে সমাজের ভ্রান্ত ধারণাগুলো দূর করা সম্ভব হবে না। কুসংস্কার দূর করতে গণমাধ্যমকে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।

হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের স্ক্রিনিং ও টিকাদানের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের লিভার বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ কামরুল আনাম। তিনি বলেন, ‘এই রোগটি প্রায়ই উপসর্গবিহীন থাকে। কাজেই আক্রান্ত পরিবারের সদস্যদের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ। সর্বোপরি রোগ প্রতিরোধে আমাদের সমন্বিত উদ্যোগ বাড়ানো জরুরি।’

হেপাটাইটিস রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধে কথা বলেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ শারমিন আব্বাসি। তিনি বলেন, ‘মায়েদের শরীর থেকে শিশুর শরীরে হেপাটাইটিস সংক্রমিত হওয়ার বেশি ঝুঁকি থাকে শিশুর জন্মের সময়। এই সংক্রমণ থেকে প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হলো গর্ভকালীন প্রতিটি সময়ে নিয়মিত পরীক্ষা–নিরীক্ষা করানো। তবে দুঃখজনক হলো হেপাটাইটিস বি আক্রান্তের খবর জানার পরে আক্রান্ত নারী তাঁর পরিবারে সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হন। আমরা মনে করি, সরকার, বেসরকারি সংস্থা এবং সব অংশীজন মিলে কাজ করলে এ অবস্থার উত্তরণ সম্ভব।’

হেপাটাইটিস রোগ প্রতিরোধে স্বীকৃত চিকিৎসকের পরামর্শের বাইরে গিয়ে রোগীদের হারবাল ও কবিরাজি চিকিৎসা গ্রহণের প্রবণতাকে বড় বাধা হিসেবে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক দেওয়ান সাইফুদ্দিন আহমেদ।

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, যেকোনো বয়সী মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। কাজেই সঠিক তত্ত্বাবধান ও টিকা গ্রহণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

২০১৫ সালের একটি গবেষণা অনুযায়ী, আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারের প্রবীণ ব্যক্তিদের হেপাটাইটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার প্রায় ৮৩ শতাংশ বলে উল্লেখ করেন হেপাটোলজি সোসাইটি ঢাকা বাংলাদেশের মিডিয়া ও প্রকাশনা সম্পাদক তানভীর আহমাদ। তিনি বলেন, প্রবীণ ব্যক্তিরা বেশিক্ষণ বাড়িতে অবস্থান করায় তাঁদের আক্রান্তের হার বেশি। কাজেই শুধু রোগীর চিকিৎসায় সীমাবদ্ধ না থেকে পুরো পরিবারকে স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনা জরুরি।

গোলটেবিল বৈঠকের সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক।