ছেলের ব্যান্ডেজ মোড়ানো হাত ধরে বসে আছেন মা

৯০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া রহিম উল্লাহর পুরো শরীর ব্যান্ডেজ মোড়ানো। অসহায় মা পাশে বসে তার একটা হাত ধরে আছেন। আজ বেলা একটায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে
ছবি: সৌরভ দাশ

যন্ত্রণায় ছটফট করছে রহিম উল্লাহ (১৭)। সারা শরীর সাদা ব্যান্ডেজে ঢাকা। পুড়ে দগদগে লাল হয়ে আছে মুখমণ্ডল। যন্ত্রণা লাঘবে একটা ছোট বৈদ্যুতিক পাখা দিয়ে বাতাস দেওয়া হচ্ছে। তার শয্যার পাশে বসা মা হামিদা বেগম পারলে এখনি সারিয়ে তোলেন ছেলেকে। তা না পেরে অসহায়ভাবে ছেলের ব্যান্ডেজ মোড়ানো হাত ধরে বসেছিলেন তিনি।  

আজ শনিবার দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে ছেলের শয্যার পাশে বসে থাকতে দেখা গেল হামিদা বগেমকে। স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলে রহিমই সংসারের হাল ধরেছিল। সাত বছর বয়স হবে তখন। সেই বয়সেই মাছের আড়তে–বাজারে নানা কাজে লেগে পড়ে। পাঁচ–সাত বছর ধরে নিয়মিত ট্রলারে যায় মাছ ধরতে। নিজের শরীরের দিকে কখনো তাকায়নি। সংসারের জন্য খেটেই গেছে কেবল। এসব বলতে বলতে ব্যান্ডেজ মোড়ানো ছেলের দিকে তাকান তিনি। কিছু বলতে গিয়ে কেঁপে ওঠেন। ফুঁপিয়ে উঠে কেবল বলেন, ‘হায় আল্লাহ।’

গতকাল শুক্রবার সকালে কক্সবাজারের ৬ নম্বর ঘাটে এফভি লাকি নামের মাছ ধরার ট্রলারে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধ হন রহিম উল্লাহসহ ১২ জন। গুরুতর দগ্ধ ১০ জনকে চমেক হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে ভর্তি করা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে দুজনকে আজ ভোরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। ঢাকায় নেওয়ার পথেই মারা যান ট্রলারের চালক আইয়ুব আলী। তিন ছেলে এক মেয়ে নিয়ে আইয়ুব আলীর সংসার। তাঁর স্ত্রী রাবেয়া বেগম স্বামীর মৃত্যুতে দিশাহারা।

দগ্ধ বাকি আটজন এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে চিকিৎসাধীন। তাঁদের শরীরের ২০ থেকে ৯০ ভাগ পুড়ে গেছে। তাঁদের সবার অবস্থাই সংকটজনক বলে জানালেন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ এস খালেদ। তিনি বলেন, দগ্ধ আটজনের শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অবস্থা ভালো নয়।

দগ্ধ জেলেদের সবাই পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাঁদের মধ্যে রহিম উল্লাহর বাড়ি কক্সবাজার সদরের চরপাড়া এলাকায়। মা ও তিন ভাইবোনকে নিয়ে তার সংসার। একেকবার সপ্তাহ দুয়েক কিংবা আরও বেশি সময়ের জন্য সাগরে চলে যেতেন। কতবার সাগরে ঝড়–ঝঞ্ছার মুখোমুখি হয়েছেন, সে গল্প মায়ের অনেক শোনা। সেই ছেলে কিনা এখন নির্বাক। তার শরীরের ৯০ ভাগ পুড়ে গেছে।

রহিমের দুই হাত, মুখমণ্ডল, বুক, কোমর, দুই পা দগ্ধ। মুখ ফুলে গেছে। কথা বলার অবস্থা নেই। মা হামিদা বললেন, ‘ছেলেটি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ১২ দিন পর সাগর থেকে মাছ ধরে ফিরেছে। শুক্রবার সকালে আবার মাছ বিক্রির জন্য ট্রলারে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর শুনি ছেলে আহত। দৌড়ে কক্সবাজার হাসপাতালে যাই। সেখান থেকে এখানে পাঠিয়ে দিল।’
স্বামী হারানোর পর ছেলেকে নিয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াচ্ছিলেন হামিদা। রহিম উল্লাহর আয়রোজগারে চলত পরিবার। ছেলের জন্য বউ আনবেনও ভেবেছিলেন। কিন্তু এখন সব অনিশ্চিত। ছেলের কিছু হয়ে গেলে অথই সাগরে পড়বেন এই নারী।

দগ্ধদের মধ্যে একটু ভালো অবস্থায় রয়েছেন শফিকুল ইসলাম (২৬)। তাঁর শরীরের ২০ ভাগ পুড়েছে। তিনি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘সকালে ঘর থেকে ট্রলারে যাই। কেবিনের ভেতর মুঠোফোন দেখতে দেখতে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। হঠাৎ নিজেকে আমি আবিষ্কার করি পানির মধ্যে। তখন পাশে দুটি নৌকা ছিল। কোনোরকমে একটিতে উঠে পড়ি। এর পর পুরো শরীরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা অনুভব করি।’

শফিকুল ইসলামের পা, হাত, মুখ ও গলা পুড়ে গেছে। তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়ে রয়েছেন। শফিকুলের বোন রশিদা আকতার তাঁর দেখভাল করছেন। রশিদা বলেন, সংসারে শফিকই একমাত্র উপার্জনক্ষম। সে এখন জীবন শঙ্কায় পড়েছে।

মো. শাহীন ভোলা জেলার বাসিন্দা। তাঁর শরীরের পুড়েছে ৬০ ভাগ। তাঁকে এখানে দেখাশোনারও কেউ নেই। একই ট্রলারের অপর মাঝি আবদুল মোতালেব হাসপাতালে শুশ্রূষা করছেন তাঁর। মোতালেবের বাড়িও ভোলা জেলায়। মোতালেব বলেন, ‘তাঁকে দেখার কেউ নেই। বাড়ি থেকে তাঁর পরিবার বারবার ফোন করে খবর নিচ্ছে। আমি কী জবাব দেব তাদের, বুঝতে পারছি না।’