দৃঢ় মনোবল আর প্রচেষ্টা থাকলে কোনো বাধা পেরোনোই কঠিন নয়। দরকার ইচ্ছাশক্তি, আত্মবিশ্বাস আর কঠোর পরিশ্রম। আমাদের আশপাশে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নিজেদের জীবনগাথায় লিখে চলেছেন অদম্য জয়ের গল্প। তাঁদের সেই সাফল্য ব্যক্তিগত অর্জনের সীমানা পেরিয়ে সমাজের নানাবিধ প্রতিবন্ধকতাকেও চ্যালেঞ্জ করেছে। তেমনই কয়েকজনের গল্প নিয়ে ধারাবাহিক এ আয়োজন। আজ জানব ময়মনসিংহের অজপাড়াগাঁয়ের বাসিন্দা মাজিদা বেগম–এর জীবনগল্প।
আমি মাজিদা বেগম। আমার জন্ম ময়মনসিংহের একটি অজপাড়ায়। দরিদ্র পরিবারে বেড়ে উঠেছি। সংসারে অভাব থাকলেও মা-বাবা আমার লেখাপড়া বন্ধ করেননি। মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করার পর প্রতিবেশীরা আমার বাবাকে বলেছিলেন, ‘মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন।’ বাবা শোনেননি তাঁদের কথা।
এরপর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করার পর পড়শিরা আমাকে উৎসাহ দেওয়া তো দূরে থাক, উল্টো আমার বাবাকে নানা নেতিবাচক কথা বলতে শুরু করেন। যেমন মেয়েদের এত লেখাপড়া করে কী হবে? এখনই বিয়ের উপযুক্ত সময়, মেয়ের বিয়ে দিয়ে ভারমুক্ত থাকেন ইত্যাদি। তবে এসব কথায় বাবা কখনো দমে যাননি। সবাইকে তিনি শুধু একটা কথাই বলতেন, ‘মেয়েরাও অনেক দূর যেতে পারে। যতটুকু সামর্থ্য হয়, আমি আমার মেয়েকে লেখাপড়া করাব।’
আমি ময়মনসিংহের গৌরিপুর সরকারি কলেজ থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করি। রেজাল্ট ভালোই হয়। কিন্তু লেখাপড়া শেষ করে কোনো চাকরি পাচ্ছিলাম না। পরিবার থেকে হাতখরচ নিতে ইচ্ছা করত না। তাই স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য টিউশনি শুরু করি। এরই মধ্যে আমার বিয়ে হয়।
জীবনের নতুন অধ্যায়ের আড়ালেও আমি স্বপ্ন দেখতে ভুলিনি। কিছু একটা করার সংকল্পে সব সময় বিভোর থাকতাম। কিন্তু কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সত্যি বলতে, মফস্সল এলাকায় নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ অনেক কম। নানা রকম হতাশা এসে ভিড় করে। আমি বিকল্প পথের সন্ধানে সচেষ্ট থাকি। অবশেষে স্বামীর কর্মসূত্রে গাজীপুর চলে আসি। এখানেও চাকরির সুযোগ খুঁজি, পাই না।
গাজীপুর এলাকায় অনেক রপ্তানিমুখী পোশাকের কারখানা। স্বামীসহ অনেকেই আমাকে গার্মেন্টসের কাজে যোগ দিতে বলে। আমি রাজি হইনি। এত দূর লেখাপড়া করে গার্মেন্টসে চাকরি করব? মন থেকে মেনে নিতে পারছিলাম না। এ ছাড়া এই সেক্টর নিয়ে আমার কোনো ধারণা ছিল না।
তৈরি পোশাক কারখানায় নারীদের জন্য সেলাই ছাড়াও যে বৈচিত্র্যময় নানা কাজ আছে, তা আমার জানা ছিল না। শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি আইরিশ গার্মেন্টস লিমিটেডে ‘কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর’ হিসেবে যোগদান করি।
কিছুদিন যাওয়ার পরই আমি কাজটাকে ভালোবাসতে শুরু করি। কোয়ালিটি বিভাগের দায়িত্ব বুঝতে শুরু করি। একটি পোশাক রপ্তানির পেছনে অনেক ধাপ কাজ করে। প্রতিটি ধাপে কোয়ালিটি চেক জরুরি, যেখানে দেশ ও প্রতিষ্ঠানের সুনাম জড়িত। ধীরে ধীরে কাজের প্রতি আমার মনোযোগ বাড়তে থাকে।
কিন্তু আবার ভেতরে ভেতরে পরিবর্তনের পথও খুঁজতে থাকি। বিষয়টা আমার সিনিয়রদের নজরে আসে। অবশেষে আলোর বার্তা এল। ব্র্যাকের ‘লিডারশিপ অ্যান্ড সফট স্কিলস প্রোগ্রামে’ প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হলাম। তখনো আমি এই প্রশিক্ষণ বিষয়ে কিছুই জানতাম না। কিন্তু কয়েকটা সেশন যাওয়ার পর আমার ভেতর বিশাল পরিবর্তন এল। যেন নিজেকে খুঁজে পেলাম। নিজের হারানো কণ্ঠস্বর ফিরে পেলাম। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে শিখলাম। আমি কাজের বা দায়িত্বের নতুন ভাষা শিখলাম। আমার সব সংকোচ আর জড়তা কেটে গেল। সহকর্মীদের সঙ্গে অনেক সহমর্মিতা নিয়ে কথা বলতে লাগলাম।
আমাদের কাজে ডেডলাইনের (সময়সীমা) কারণে অনেক চাপ থাকে। কিন্তু কীভাবে নিজেকে শান্ত রেখে চাপমুক্ত রাখতে হয়, তা শিখলাম এবং কাজের ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করা শুরু করলাম। কর্মক্ষেত্রে চাপমুক্ত থাকতে শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম শেখানো হয়। রেগে গেলে কীভাবে নিজেকে শান্ত রাখতে হয়, তা শিখলাম। অনেক সময় অনেকগুলো কাজ চলে আসে, কিন্তু কোনটা আগে গুরুত্ব দেব, তা বুঝতে পারতাম না। এখন সহজেই বুঝি।
সিনিয়রদের সঙ্গে কথা বলতে ভয় লাগত, সেটিও এখন কেটে গেছে। সহকর্মীদের সঙ্গেও কথা গুছিয়ে বলতে পারতাম না। প্রশিক্ষণের পর সেটাও পারলাম। বুঝলাম, স্পষ্ট করে কথা বলা একজন মানুষের অনেক বড় শক্তি। সহকর্মীদের সঙ্গে একটু দরদ দিয়ে কথা বললে ফলাফল অনেক ভালো হয়। সব মিলিয়ে ব্র্যাক থেকে নেওয়া প্রশিক্ষণ আমার মধ্যে জাদুর মতো কাজ করল, বলতে গেলে আমার জীবন বদলে দিল।
একসময় প্রমোশন পেয়ে আমি ‘কোয়ালিটি অডিটর’ হই। হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস ফিরে পাই। আমার সহকর্মী আর সিনিয়রদের সঙ্গে আগের চেয়ে পেশাগত সম্পর্ক অনেক মজবুত হয়, যা আমার পারিবারিক জীবনেও প্রভাব ফেলে। এখন সংসারটাকে আগের চেয়ে অনেক গুছিয়ে রাখার চেষ্টা করি।
স্বামীর সঙ্গে আচরণেও পরিবর্তন আসে। তিনি যদি মানসিক চাপে থাকেন, তাঁকেও শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম করার জন্য বলি। আমরা পরস্পর মন খুলে কথা বলি। আমি আর আমার স্বামী দুজনেই আয় করি, ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়ও করি। জীবনটা আগের চেয়ে অনেক আনন্দময় হয়েছে। আমার এই উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা আমার কন্যাকেও দিতে চাই। যেন সে উচ্চশিক্ষা অর্জন শেষে আমার চেয়েও অনেক দূর যেতে পারে।
যে আমি শুরুতে কর্মক্ষেত্রকে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করতে পারিনি, সেই আমার ভেতরে যেন অন্য এক মাজিদা জন্ম নেয়। আসলে প্রত্যেক মানুষের ভেতরে অপার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু হতাশায় ডুবে থাকলে সেই সম্ভাবনা দেখা যায় না। এটা যদি কেউ বুঝতে পারে, তাহলে সবক্ষেত্রেই প্রয়োগ করতে পারবে।
শুধু ইতিবাচক মন নিয়ে চেষ্টা করে যেতে হয়। কোনো কাজই আসলে ছোট না। কাজকে ছোট ভাবলে নিজেকেই অসম্মান করা হয়। যেকোনো কাজ ভালোবেসে আর দায়িত্ব নিয়ে করলে তা সবার নজরে আসতে বাধ্য। মানুষ আপনাকে সম্মান দেবে। আমিই তার দৃষ্টান্ত।
এখন আমার লক্ষ্য কোয়ালিটি অডিটর থেকে কোয়ালিটি ম্যানেজার হওয়া। এই অর্জনে নারী হিসেবে কোনো বাধাই আমি মনে করি না। আমার পরিবর্তন দেখে সহকর্মীরা অনেক উৎসাহ দেন। আমার থেকে পরামর্শ নেন কীভাবে তাঁরাও সফল হবেন। আমি তাঁদের নিজের গল্প বলে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করি।
এখন ছুটিতে যখন গ্রামের বাড়ি যাই, সেই পড়শিদেরই বাড়তি মনোযোগ ও ভালোবাসা পাই, যা আমাকে আরও এগিয়ে যাওয়ার পথে শক্তি সঞ্চার করে। আমি বিশ্বাস করি, নিজের পথে দৃঢ়ভাবে হাঁটতে পারলে আমার মতো অনেকেই একদিন নিজেদের গল্প দিয়ে অন্যকে শক্তি ও প্রেরণা জোগাতে পারবে।