বিশ্বমানের যেসব গবেষণায় বিজ্ঞানীরা কাজ করে নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সদিচ্ছা থাকলে সে রকম মৌলিক গবেষণা অবকাঠামো দেশে তৈরি সম্ভব। মৌলিক গবেষণা করতে গেলে উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন সরঞ্জাম দরকার। একই সঙ্গে গাণিতিক যোগ্যতায় দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে।
আজ শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিটিউট অডিটরিয়ামে চলতি বছর বিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ীদের গবেষণা নিয়ে আয়োজিত এক বিজ্ঞান–বক্তৃতা অনুষ্ঠানে এ কথাগুলো বলেন বক্তারা। বিজ্ঞানবিষয়ক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তা এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
চিকিৎসাশাস্ত্রে রেগুলেটরি টি–সেল আবিষ্কার করে এবার নোবেল পেয়েছেন তিন বিজ্ঞানী ম্যারি ই ব্রানকো, ফ্রেড রামসডেল ও সিমন সাকাগুচি। শরীরের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা নানা ধরনের রোগজীবাণু থেকে রক্ষা করে। কোনো কোনো সময় যে কোষগুলো আমাদের বাঁচায়, তারাই ভুল করে শরীরকেই আক্রমণ করে বসতে পারে। সে কারণে দেহে বাসা বাঁধতে পারে অটোইমিউন ডিজিজ। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের দেহের এক ধরনের কোষ এ সংকট থেকে আমাদের বাঁচাতে পারে। সেটি হলো রেগুলেটরি টি–সেল। এ সেল আবিষ্কার করে চিকিৎসাশাস্ত্রে এবার নোবেল পেয়েছেন এই তিন বিজ্ঞানী।
অনুষ্ঠানে এর পেছনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সহজ ভাষায় দর্শক–শ্রোতাদের সামনে তুলে ধরেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সের ইমিউনোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক রোজী সুলতানা।
উপস্থাপনা শেষে আমাদের দেশেও এ রকম বিশ্বমানের গবেষণা অবকাঠামো তৈরি সম্ভব কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের কিছু বাধা আছে। যেমন মৌলিক গবেষণা করতে গেলে আমাদের বিশ্বমানের অবকাঠামো দরকার। এ জন্য নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে একেবারে নিচ পর্যন্ত সদিচ্ছা থাকতে হবে।’
অধ্যাপক রোজী সুলতানা বলেন, ‘মৌলিক গবেষণা করতে গেলে আমাদের হাইটেক ইকুইপমেন্ট দরকার হবে। এগুলো কিনতে গেলে দেখা যায় দাম কোটি কোটি টাকা। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের সরঞ্জাম আছে। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের এগুলো কেনার সামর্থ্য নাই। এ রকম গবেষণা অবকাঠামো তৈরি করা সম্ভব যদি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সদিচ্ছা থাকে এবং যদি আর্থিক সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠা যায়।’
ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের ফিজিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক ও বিজ্ঞানচিন্তা ম্যাগাজিনের উপদেষ্টা আরশাদ মোমেন বলেন, ‘আমাদের মূল দুর্বলতা হলো গাণিতিক যোগ্যতায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা এ জায়গাতে সব সময় পিছিয়ে আছি। আমাদের লক্ষ্য বিজ্ঞান নিয়ে মৌলিক গবেষণা, কিন্তু আমাদের বেশির ভাগ জায়গা প্রযুক্তি খেয়ে ফেলছে।’
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এ মুহূর্তে যদি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বাজেটটা দেখি, সিংহভাগই ব্যয় হচ্ছে প্রযুক্তি খাতে। বিজ্ঞানের একটি ভিত্তি তৈরি করতে যে ধরনের গবেষণা দরকার, সেদিকে দৃষ্টি নাই। এটা গাছের গোড়া কেটে উপরে পানি ঢালার মতো অবস্থা।’
রসায়নে এ বছর নোবেল পেয়েছেন ধাতব জৈবকাঠামোর আবিষ্কারকেরা। এ কাঠামো পানি থেকে ক্ষতিকর পদার্থ সরানো, মরুভূমির বায়ু থেকে পানি সংগ্রহসহ অনেক কঠিন সমস্যার সমাধান করেছে। নোবেলজয়ী রিচার্ড রবসন, সুসুমু কিতাগাওয়া এবং ওমর এম ইয়াগি। তাঁদের গবেষণা এবং আবিষ্কার নিয়ে কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মিঠুন সরকার।
উপস্থাপনা শেষে শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা যারা গবেষণা করি তারা বহুমুখী সমস্যার মধ্যে পড়ি। ল্যাবে সরঞ্জামের সংকট, থাকলেও দেখা যায় নানা ত্রুটি। আবার শিক্ষার্থীও পাওয়া যায় না। পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতিও নাই।’
এরপর শুরু হয় পদার্থবিদ্যায় নোবেল নিয়ে আলোচনা। চলতি বছর পদার্থবিদ্যায় নোবেল পেয়েছেন জন ক্লার্ক, মিশেল দ্যভোর ও জন মার্টিনিস। তাঁরা অতিক্ষুদ্র কোয়ান্টাম জগতের সীমা ছাড়িয়ে দৃশ্যমান পর্যায়ে কোয়ান্টাম ঘটনার প্রমাণ দেখিয়ে নোবেল জিতেছেন। তাঁদের গবেষণা সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ান্টাম কম্পিউটিং সেন্টারের পরিচালক মাহ্দী রহমান চৌধুরী।
অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। তিনি বলেন, আজকের এই আলোচনাটি ভবিষ্যতে এমন এক ভিত্তি স্থাপন করবে, যা একদিন বাংলাদেশকে বিজ্ঞানচর্চায় কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে।
বক্তৃতা শেষে অনুষ্ঠিত হয় কুইজ পর্ব। কুইজ বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন বক্তারা। এ পর্ব পরিচালনা করেন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদনা দলের সদস্য শিবলী বিন সারওয়ার। মূল অনুষ্ঠান উপস্থাপন করেন সম্পাদনা দলের আরেক সদস্য উচ্ছ্বাস তৌসিফ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিজ্ঞানচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসার।