স্তন ক্যানসারের চিকিৎসার আগে এর পর্যায় নির্ণয় জরুরি

‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় ১১ অক্টোবর।

‘স্তন ক্যানসারের কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর রয়েছে। বয়স্ক নারী-পুরুষেরা বেশি ঝুঁকিতে, অর্থাৎ এটা বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত। এ ছাড়া নির্দিষ্ট বয়সের আগেই যেসব নারীর ঋতুস্রাব শুরু হয় এবং দেরিতে বন্ধ হওয়া, যাঁরা জন্মনিরোধক বড়ি খান, কায়িক শ্রম করেন না, দেহের স্থূলতা নিয়ন্ত্রণ করেন না, বংশের কারও এ ক্যানসার ছিল—এ ধরনের মানুষদের নিয়মিত স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে সতর্ক থাকতে হবে।’

বলছিলেন আহছানিয়া মিশন ক্যানসার অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল অনকোলোজি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট এবং প্রফেসর অব মেডিসিন ডা. মো. কুদরত-ই-ইলাহী। এসকেএফ অনকোলোজির আয়োজনে ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ছিলেন তিনি। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে স্তন ক্যানসারের বর্তমান অবস্থা, রোগনির্ণয়, চিকিৎসাব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে পরামর্শ দেন ডা. মো. কুদরত-ই-ইলাহী। ১১ অক্টোবর পর্বটি সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলোজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।

অক্টোবর মাস, স্তন ক্যানসার নিয়ে বিশ্বব্যাপী সচেতনতার মাস হিসেবে পালিত হয়। এবারের প্রতিপাদ্য ‘স্তন ক্যানসার, চাই দ্রুত নির্ণয় ও পরিপূর্ণ চিকিৎসা’। অনুষ্ঠানের শুরুতেই এ সম্পর্কে তথ্য দেন উপস্থাপক নাসিহা তাহসিন। তিনি বলেন, ‘এ মাস পালনের কিছু উদ্দেশ্য রয়েছে। সেগুলো হলো স্তন ক্যানসার নিয়ে সবার মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও ভুল ধারণার পরিবর্তন, এ সম্পর্কে জ্ঞান বাড়ানো, প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তকরণ পদ্ধতি ও সুবিধা সম্পর্কে বোঝানো এবং চিকিৎসাগত মানসিক ও সামাজিকভাবে রোগীদের প্রতি সমর্থন বাড়ানো।’

স্তন ক্যানসারের কারণ সম্পর্কে ডা. মো. কুদরত-ই-ইলাহী বলেন, ‘আমাদের শরীরে কোষগুলো স্বাভাবিকভাবে পরিবর্তিত হয়, একসময় থেমে যায়। কিন্তু ক্যানসারের ক্ষেত্রে কোষগুলো অপ্রতিরোধ্যভাবে বাড়তে থাকবে, যা থামবে না। তখন এটাকে আমরা ক্যানসার বলব। কোষের এ অস্বাভাবিক পরিবর্তন যখন স্তনে হয়, এটাকে আমরা স্তন ক্যানসার বলতে পারি।’

স্তন ক্যানসারের লক্ষণ সম্পর্কে কুদরত-ই-ইলাহী বলেন, ‘উপসর্গগুলো হলো সুনির্দিষ্ট বয়স পরে কেউ যদি স্তনে ব্যথাহীন গোটা, বগলের নিচে কোনো ব্যথাহীন চাকা ইত্যাদি পেয়ে থাকেন। এগুলোকে আমরা এ ধরনের ক্যানসারের প্রাথমিক উপসর্গ বলে মনে করি।’

ক্যানসার নির্ণয়ে কত ধরনের স্ক্রিনিং রয়েছে? উপস্থাপকের এ প্রশ্নের জবাবে ডা. মো. কুদরত-ই-ইলাহী বলেন, ‘স্ক্রিনিং মানে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার শনাক্তকরণের উপায়। এটা কয়েক ধরনের রয়েছে। একটা আছে সেলফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন অর্থাৎ নির্দিষ্ট বয়সের পর একজন নারী নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা করবেন। এ সময় অস্বাভাবিক কিছু পেলে তিনি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন। সেখানে তাঁর ক্লিনিক্যাল এক্সামের পর চিকিৎসক আলট্রাসনোগ্রাম করবেন। এরপর মেমোগ্রাম করতে হয়। এগুলো অনুসরণ করলে প্রাথমিক পর্যায়ে স্তন ক্যানসার শনাক্ত করা সহজ এবং সুস্থতার হার অনেক গুণ বেশি।’

সেলফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন কত বছর বয়স থেকে শুরু করা উচিত? এ প্রসঙ্গে ডা. মো. কুদরত-ই-ইলাহী বলেন, ‘যাঁরা ঝুঁকিতে আছেন, তাঁদের ৩০ বছরের পর বা তার আগেই সেলফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন শুরু করা উচিত। তবে যাঁদের বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে, তাঁদের এ ধরনের পরীক্ষা করা অবশ্যই দরকার।’

বাংলাদেশে স্তন ক্যানসারের বর্তমান অবস্থা, রোগনির্ণয়, ডায়াগনসিস এবং চিকিৎসা-সুবিধা বিষয়ে পরামর্শ দেন ডা. মো. কুদরত-ই-ইলাহী।

উপস্থাপক জানতে চান, মেমোগ্রাম কখন করাতে হয়? ডা. মো. কুদরত-ই-ইলাহী বলেন, ‘এটা ৪০ বছর বয়স পার হওয়ার পর করা দরকার। কিন্তু ঝুঁকিতে থাকলে বয়স ৩০ হলেই করা উচিত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা “এমআরআই” করতে পরামর্শ দিয়ে থাকি।’

স্তন ক্যানসারের ধরন সম্পর্কে ডা. মো. কুদরত-ই-ইলাহী বলেন, ‘স্তন ক্যানসারের শ্রেণি বিভাজন করতে গেলে এর “রিসেপটর” সম্পর্কে জানা দরকার। এটা তিন ধরনের। ইস্ট্রোজেন রিসেপটর (ইআর), প্রজেস্ট্ররেন রিসেপটর (পিআর) এবং হার-টু। এ তিনটির পজিটিভ-নেগেটিভ থাকার ওপর স্তন ক্যানসারের ধরন নির্ণয় করা হয়। তবে এ তিনটির ফলাফল যদি নেগেটিভ হয়, তবে সেটা মারাত্মক। তাই স্তন ক্যানসারের চিকিৎসার আগে এর ধরন বা পর্যায় নির্ণয় করা আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত।’

স্তন ক্যানসারের চিকিৎসাপদ্ধতি বিষয়ে ডা. মো. কুদরত-ই-ইলাহী বলেন, ‘যেকোনো ক্যানসারের ক্ষেত্রে প্রথমে “কোর বায়োপসি” করা হয়, যা বিদেশে “এফএনএসি” করা হয়। তারপর কিছু ধরা পড়লে ইমেজিং মানে সিটি স্ক্যান, এমআরআই, বোন স্ক্যান, পেট সিটি স্ক্যান করতে পারি। যার মাধ্যমে জানা যায় ক্যানসারটা কোন পর্যায়ে আছে। এটা জানার পর টিউমার বোর্ডে চিকিৎসা হয়। মানে অনকোলজিস্ট, সার্জন, রেডিয়শনিস্টসহ প্রয়োজনবোধে আরও অনেককে নিয়ে একটা মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি বোর্ড গঠিত হয়। যারা চিকিৎসাপদ্ধতি নির্ধারণ করেন।’

স্তন ক্যানসারের রোগীর চিকিৎসার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে ডা. মো. কুদরত-ই-ইলাহী বলেন, ‘গত এক দশকে ক্যানসার নিয়ে যে পরিমাণ গবেষণা ও বিভিন্ন ধরনের আধুনিক ও সহজলভ্য চিকিৎসাপদ্ধতি এসেছে, তাই এর বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার হার বেশি। এমনকি অনেকে “স্টেজ ফোর”-এ থাকার পরও সুস্থভাবে জীবনযাপন করছেন। দেখে বোঝাই যায় না যে তিনি একজন ক্যানসার যোদ্ধা।’

প্রসঙ্গক্রমে উপস্থাপক জানান, বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র ইউজিএমপি ও অ্যানভিজা ব্রাজিল অনুমোদিত প্ল্যান্ট হলো এসকেএফ অনকোলোজি। ফলে এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রায় ২৭টি দেশে এবং দক্ষিণ আমেরিকায় রপ্তানি হচ্ছে।

স্তন ক্যানসার রোগীর মানসিক স্বাস্থ্যে কী কী প্রভাব ফেলে? এ বিষয়ে ডা. মো. কুদরত-ই-ইলাহী বলেন, ‘শুধু স্তন ক্যানসার নয়, সব ধরনের ক্যানসারের রোগীর ক্ষেত্রেই তাঁদের মানসিক চাপ থাকে। যাকে আমরা বলি “পোস্ট ট্রমাটিক স্টেস ডিসঅর্ডার”। মানে রোগী চিন্তা করেন “আমার কী হবে” বা সুস্থ রোগীদের ক্ষেত্রে “আমার কি আবার ক্যানসার হবে?” তাই এমন পরিস্থিতিতে পড়া রোগীদের পরিবারের অন্য সদস্যরা ভালোভাবে যত্ন নিতে হবে।’

স্তন ক্যানসারের দেশ ও বিদেশের মধ্যে চিকিৎসাব্যবস্থার পার্থক্য সম্পর্কে ডা. মো. কুদরত-ই-ইলাহী বলেন, ‘পার্থক্যটা শুধু অবকাঠামোগত। আরেকটা হলো, জনসংখ্যা অনুপাতে চিকিৎসাসেবা যাঁরা দেবেন, এমন লোকবল সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়। তবে চিকিৎসাপদ্ধতি আমরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনেই করি। তাই আমাদের সচেতন থাকতে হবে, যেন প্রাথমিক পর্যায়েই স্তন ক্যানসার শনাক্ত করা যায়।’