মফস্সল শহরে বসন্তের এক নির্জন জ্যোৎস্না রাতে শুরু হয়েছে মাকে নিয়ে এই কাহিনি। প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও কথাশিল্পী আনিসুল হকের সদ্য প্রকাশিত এই উপন্যাসের নাম ‘কখনো আমার মাকে’। একই শিরোনামে শামসুর রাহমানের বিখ্যাত কবিতা থেকেই এই উপন্যাসের নামকরণ। উপন্যাসটির প্রথম পাতা পার হলেই পুরো কবিতাটিও পেয়ে যাবেন পাঠকেরা। আজ রোববার বিকেলে কবিতার পঙ্ক্তিগুলো নিয়ে তৈরি করা গানটিও গেয়ে শোনান শিল্পী রফিকুল আলম।
কারওয়ান বাজারের প্রগতি ভবনে প্রথম আলো কার্যালয়ে দশম তলার সেমিনারকক্ষে সহকর্মীদের নিয়ে নতুন উপন্যাসের প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন লেখক। সেখানেই গানটি শুনিয়েছেন রফিকুল আলম। পরে আরেকটি গান শোনান শিল্পী দিনাত জাহান মুন্নী। সেটিও মাকে নিয়ে—‘ও তোতা পাখি রে...’।
গানে গানে শুরু হওয়া এই আয়োজনে অতিথি হয়ে এসেছিলেন বাংলা নাটকে মায়ের চরিত্রে অনন্য অভিনয় করে অনুরাগীদের হৃদয়ে মাতৃময়ী হয়ে ওঠা অভিনয়শিল্পী দিলারা জামান। অল্প কথায় অসামান্য কথা বলেন তিনি। এ দেশের মায়েরা চিরকাল নীরবে চোখের পানি ফেলেন। সন্তানের আনন্দে তাঁদের চোখ ভিজে যায়, সন্তানের দুঃখ–বেদনায় তাঁদের চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে থাকে। তিনি আরও বলেন, ৮১ বছর চলছে তাঁর বয়স। উত্তরায় থাকেন। নিজেকে বললেন ‘দূরবাসিনী’ এমনকি ‘বন্দিনী’। একা চলাফেরা করতে পারেন না। তাঁর দুই মেয়ে প্রবাসী। তাঁদের কাছে গিয়ে থাকতে পারেননি। এই দেশ তাঁকে মায়ের মতো টানে। দেশ আর মানুষের ভালোবাসার টানে ফিরে এসেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক বলেন, গল্প বলার এক অসাধারণ শক্তিময়তা রয়েছে আনিসুল হকের। তিনি খুব স্বতঃস্ফূর্ত ভাষায় কাহিনি বর্ণনা করে যেতে পারেন। পাঠকের কাছে সবকিছু সহজ –সরলভাবে প্রকাশিত হয়। কোনো দুর্বোধ্যতায় পীড়িত হতে হয় না। এই উপন্যাসের ভাষাও তেমনি সাবলীল। গত শতকের সত্তর দশকের প্রেক্ষাপটে একটি মফস্সল শহরে বেড়ে ওঠা মানুষের কাহিনি। মুক্তিযুদ্ধের ছায়াপাত রয়েছে আখ্যানে। কিছুটা লেখকের আত্মজৈবনিক। যেমন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালি’তে রয়েছে। আনিসুল হকের এই উপন্যাসে সত্তর দশকের সমাজ, পরিবেশ ও জীবনযাত্রার পরিচিতিও উঠে এসেছে। তিনি এই আক্ষেপও করেন যে সাংবাদিকতা না করে শুধু লেখালেখি করলে হয়তো আরও ঢের ভালো কবিতা ও কথাসাহিত্য তাঁর কাছ থেকে পাওয়া যেত।
প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘আনিসুল হক একটি পথ বেছে নিলে ভালো হতো কি না, তা আসলে নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে জীবন, সমাজ, প্রথম আলোর প্রয়োজনে তাঁকে সাংবাদিকতা করতে হয়। নানা ব্যস্ততা, চাপ সহ্য করে তার মধ্যেই তাঁকে সৃজনশীল লেখালেখি চালিয়ে যেতে হয়। আমাদের সবার মঙ্গল কামনা থাকবে তাঁর প্রতি, তাঁর লেখা অব্যাহত থাক।’
মতিউর রহমান তাঁর বক্তব্যে গানটি গেয়ে শোনানোর জন্য শিল্পী রফিকুল আলমকে ধন্যবাদ জানান। দিলারা জামানের একটি অজানা দিক তুলে ধরেন তিনি। একসময় দিলারা জামান রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। কবিতা লিখতেন। তখন তাঁর নাম ছিল দিলারা আহমেদ। ১৯৬৪ সালে ছাত্র ইউনিয়নের একটি সংকলনে তাঁর একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। তা ‘বিদ্রোহী বর্ণমালা’ নামে নতুন করে প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে। কবিতাটি পড়ে শুনিয়ে সংকলনটি দিলারা জামানকে উপহার দেন মতিউর রহমান।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই নতুন উপন্যাস, সাংবাদিকতা, লেখালেখি নিয়ে কথা শুরু করেছিলেন আনিসুল হক। সঞ্চালকও ছিলেন নিজেই। বললেন, ভালো–খারাপ যেমনই হোক, একটা নতুন বই প্রকাশিত হওয়া একজন লেখকের কাছে খুবই আনন্দের। গল্পের মতো করেই তিনি বলে গেলেন, ২০২৩ সালের প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায় ‘শেফালি আমার মা’ নামে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল। আখ্যানটি ছিল সংক্ষিপ্ত। এখন কবি শামসুর রাহমানের কবিতার নামে নাম দিয়ে পুরো কাহিনি প্রকাশিত হলো। বইটির মায়ের প্রথম সন্তানের জন্ম একাত্তরে। একটি প্রজন্মের বেড়ে ওঠা, মা, মাতৃভূমি সব মিলিয়েই এই বই।
প্রথমা থেকে প্রকাশিত বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন সব্যসাচী হাজরা। আর দুদিন বাদেই শুরু হচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। মেলায় প্রথমার স্টলে পাওয়া যাবে আনিসুল হকের এই নতুন উপন্যাস। তবে তাঁর লেখার যেসব অনুরাগী এতটা বিলম্ব করতে চান না, তাঁরা প্রথমার বিক্রয়কেন্দ্রসহ মহানগরীর সব বইয়ের দোকান থেকে উপন্যাসটি সংগ্রহ করতে পারেন। আর ঘরে বসে এটিসহ যেকোনো বই পেতে চাইলে প্রথমা ডটকমে ফরমাশ দিলেই বাড়িতে চলে যাবে পছন্দের বই।