ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগই এখন অপপ্রয়োগ

প্রতীকী ছবি

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যত আইনের শাসন নয়, আইন দ্বারা শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। এই আইন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের সুরক্ষা করে না; বরং নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক ও ভীতি তৈরি করছে। আইনটির প্রয়োগ হলেই তা অপপ্রয়োগ হিসেবে ধরে নিতে হবে।

শনিবার ‘কেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল চাই’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। নাগরিক নামের একটি সংগঠনের উদ্যোগে এই আলোচনায় অংশ নেন শিক্ষক, গবেষক, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী, ভুক্তভোগী সাংবাদিক। তাঁদের মতে, এই আইনে সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা, মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার হরণের বাস্তবতা বিদ্যমান, তাই অবিলম্বে এটি বাতিল হওয়া প্রয়োজন।

আলোচনায় অংশ নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, যারা অন্যায় ও অবিচার করে, তাদের বিরুদ্ধে যাতে কেউ কথা বলতে না পারে সে জন্য এই আইন করা হয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হয়ে লেখক মুশতাকের কারাগারে মৃত্যু এবং সাম্প্রতিক সময়ে নওগাঁয় হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুসহ বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ করে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, এই আইন বাতিল করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তাঁর মতে, সাম্প্রতিক আইনগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থান ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাকে আরও জটিল ও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।

নাগরিকের ডিজিটাল সুরক্ষার প্রয়োজন আছে কিন্তু ২০১৮ সালে প্রণীত আইনে সেই সুরক্ষার লেশ মাত্র নেই
আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া

আলোচনা অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও মানবাধিকারকর্মী অধ্যাপক সি আর আবরার। তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যত আইনের শাসন নয়, আইন দ্বারা শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কোনোভাবেই ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের রক্ষা করে না; বরং নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক ও ভীতি তৈরি করছে।’ তিনি অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি জানিয়ে বলেন, আগামীতে নাগরিক সমাজের নিয়মিত, স্বতঃস্ফূর্ত, প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত সম্পৃক্ততা এবং অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সাইবার জগৎ–সংক্রান্ত যেকোনো আইন-বিধি-নীতিমালা, নির্দেশিকা প্রণয়ন করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

আলোচনার শুরুতে সঞ্চালক আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম একটি নতুন ধারণা এবং এটিকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য আইনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। নাগরিকের ডিজিটাল সুরক্ষার প্রয়োজন আছে কিন্তু ২০১৮ সালে প্রণীত আইনে সেই সুরক্ষার লেশ মাত্র নেই। এই আইনের মূল উদ্দেশ্য যেখানে নাগরিকের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। তাঁর মতে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রায় সব ধারা ও উপধারা নাগরিকদের মতপ্রকাশের সুরক্ষা ও স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার ও অন্যান্য নাগরিক অধিকারকে সীমিত ও ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষুণ্ন এবং নাগরিকদের জনবান্ধব কর্মকাণ্ডকে অপরাধীকরণ করেছে। এই আইনের মাধ্যমে মামলা করার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে যেমন দমন করা হচ্ছে, তেমনি যেকোনো প্রকারের বিরুদ্ধ মতকে দমন করতে ভূমিকা পালন করছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কোনোভাবেই ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের রক্ষা করে না; বরং নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক ও ভীতি তৈরি করছে
অধ্যাপক সি আর আবরার

ওয়েবিনারের বক্তব্যে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন মানবাধিকারকর্মী রেজাউর রহমান। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কেবল নাগরিকের কণ্ঠরোধ করছে তা নয়, এটি অপরাপর সব অধিকার হরণ করছে যা নাগরিকদের জন্য চরম নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে। বিচারপ্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, যে অভিযোগেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হোক না কেন, সাধারণত জামিন মঞ্জুর হয় না। মামলা তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত অভিযুক্ত ব্যক্তি এখতিয়ারাধীন নির্দিষ্ট সাইবার ট্রাইব্যুনালে যেতে পারেন না, এখতিয়ারভুক্ত দায়রা আদালতে যান, সেখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জামিন আবেদন নামঞ্জুর হওয়াটা ‘স্বাভাবিক প্রথায়’ পরিণত হয়েছে, যা সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী।

আলোচনায় আরও অংশ নেন গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী রোজিনা বেগম, ভুক্তভোগী সাংবাদিক আজিম নিহাদ, আফরোজা সরকার, পিক্লু নীল, নজরুল ইসলাম, শিক্ষক রুমা সরকার, আবু ফজল, আফরিন লাইলা প্রমুখ। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সদ্যপ্রয়াত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আলোচনা শেষ করা হয়।