বাঘরাঙার রাঙা ফুল

সাভারে হেমন্তে ফোটা বাঘরাঙা ফুল
ছবি: লেখক

গাছটি অদ্ভুত! পাতা দেখে মনে হলো, গাছটি বোধ হয় পেয়ারাগাছের ভাই। আবার ফল দেখে মনে হলো, ওটা বুঝি কাঁঠালচাঁপার বোন। ফুল দেখে মনে হলো, ওটির পাপড়িগুলো খানিকটা আতা ফুলের মতো।

আসলে সে কার মতো? বইপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে শেষে চেনা হলো গাছটিকে। ওটি আসলে আতাগাছেরই এক সহোদর, গোত্র ‘অ্যানোনেসি’। আতা ফুলের ছবির সঙ্গে এটির ফুল বারবার মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, আসলে আতাগাছের সঙ্গে এর মিলটা কোথায়? বাকলে মিল, পাতায় কিছুটা মিল, পাতা চওড়া ও বড়, ফুলের সঙ্গে সামান্য মিল। ফলের সঙ্গে কোনো মিলই নেই। তবে আতা আর এই গাছের ফলÑদুটিই যৌগিক ফল, অর্থাৎ একটি ফলের মধ্যে অনেকগুলো ফল থাকে, একসঙ্গে ধরে। থোকায় থোকায় কাঁঠালচাঁপা ফলের মতো আঙুলসদৃশ লম্বা ফল হয়। কাঁচা ফলের রং সবুজ, পাকলে হয়ে যায় হলদে রঙের। কাঁঠালচাঁপা ফলগুলো শক্ত আর এটা নরম। আতা ফলের মতো এ গাছের ফলও খাওয়া যায়। আঙুরের মতো থোকায় থোকায় ফল ধরে। এ গাছের গণগত লাতিন নাম ‘উভারিয়ার’ অর্থ আঙুর। ফলের কারণে এমন নাম রাখা হয়েছে, অন্য নাম ‘রেড হট পোকার’। বইপত্র ঘেঁটে এর বাংলা নাম পেলাম বাঘরাঙা বা বাঘরং ও ঘাগরঙ্গ।

বাঘরাঙা ফল
ছবি: সংগৃহীত

গত বছরের ১৪ নভেম্বর এ গাছের সন্ধান পেয়েছিলাম সাভারের বরিশাল নার্সারিতে। নার্সারির লোকেরা অবশ্য গাছটির সঠিক নাম না জানায় এর একটি মনগড়া নাম দিয়েছিলেন ‘লাল কাঁঠালিচাঁপা’। এ নামে জানামতে এ দেশে কোনো গাছ নেই। এই গাছও এসেছে বিদেশ থেকে। নার্সারিতে রেখে পরিচর্যা করায় সে গাছে ফুল-ফল ধরেছে। গাছে মাত্র একটি ফুল ফুটে ছিল। টকটকে লাল পাঁচটি পাপড়ি যেন তারার মতো ছড়িয়ে চারদিক উজ্জ্বল করে তুলেছিল। মাসখানেক পর সেখানে গিয়ে ফলের দেখা পেয়েছিলাম সেই গাছে। বাঘরাঙা গাছে ফুল ও ফল ধরে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত।

উভারিয়া গণের এই গাছ বিদেশ থেকে এলেও এর অন্তত আরও চার-পাঁচটি ভাইবোন আমাদের দেশের বনে–জঙ্গলে আছে বলে জানা যায়। বিশেষ করে কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অরণ্যে এগুলো অল্প হলেও চোখে পড়ে। ‘বাংলাদেশের উদ্ভিদ’ অভিধানে এ দেশে এই গাছের চারটি প্রজাতি ও বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ বইয়ে পাঁচটি প্রজাতির গাছ আছে বলে উল্লেখ রয়েছে। আলোচ্য গাছটির প্রজাতি ‘Uvaria Grandiflora’ (সমনাম Uvaria Purpurea)। এ প্রজাতির গাছ কাষ্ঠল লতানো স্বভাবের গুল্ম প্রকৃতির চিরসবুজ বহুবর্ষজীবী। এই গাছ ৬ থেকে ৯ মিটার লম্বা হয়। গাছের বাকল খসখসে ধূসর, বাকলের আঁশ তুলে তা দিয়ে বস্তা বানানো যায়। বাঘরাঙা গাছের ফুল বড়, ফোটার পর পাপড়ির বিস্তার হয় ১০-১২ সেন্টিমিটার, পাপড়ি ৫টি, ফুলের মাঝখানে একটি উত্তল চাকতির মতো হলদে বাদামি রঙের অঙ্গ থেকে পাপড়িগুলো চারদিকে তারার মতো ছড়িয়ে পড়ে। পাতার বোঁটার কোলে এককভাবে ফুল ফোটে। পাপড়িগুলোর গোড়ার দিকে চওড়া ও মাথার দিকে সরু, অন্য তিনটি প্রজাতির ফুলের তুলনায় এর ফুলের পাপড়ি সরু। আঙুলের মতো লম্বা ও অগ্রভাগ ভোঁতা অনেকগুলো ফল ধরে থোকায়। ফলের ভেতরে কয়েকটি বাদামি রঙের বীজ থাকে। বীজ থেকে গাছ হয়। গবেষকেরা এই গাছের রসে ক্যানসাররোধী রাসায়নিক উপাদানের খোঁজ পেয়েছেন। এ গাছের পাতা বেদনানাশক ও ফোলা কমায়। শিকড় বমি বন্ধ করে ও বাতরোগের চিকিৎসায় কাজে লাগে।

বাঘরাঙার গাছের আরও কয়েকটি সহোদর আছে এ দেশে। তারা হলো লোমরাঙা, গোলরাঙা, লটকনরাঙা। এর মধ্যে লোমরাঙা (Uvaria Hirsuta) গাছের ফুলের পাপড়ি গোলাকার, ফল থোকায় ধরে, ফলের খোসা কাঁটাযুক্ত ও হলুদ। গোলরাঙা (Uvaria Hamiltonii) গাছের ফুলের পাপড়ি ভেতরের দিকে কিছুটা বাঁকানো ও গোলাকার, রং কালচে খয়েরি। লটকনরাঙা (Uvaria Hamiltonii) গাছের ফুল লাল, তবে পাপড়ি সম্পূর্ণ প্রসারিত নয়, পাপড়ির অগ্রভাগ ভেতরের দিকে বাঁকানো, ফুল ফোটে মার্চ থেকে অক্টোবরে, ফল লম্বাটে। এসব প্রজাতির গাছের আদি নিবাস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায়। এসব গাছ এ দেশে কদাচিৎ দেখা যায়।