সরকারি সার কারখানা চালুর আগেই ঋণ শোধের চাপ

ঘোড়াশাল পলাশ সার কারখানা নির্মাণে ব্যয় হয়েছে সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা। এখন গ্যাসের অভাব, রেললাইন হয়নি।

নরসিংদীর ঘোড়াশাল সার কারখানা
ছবি: প্রথম আলো

নরসিংদীতে নবনির্মিত ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা উৎপাদনে যাওয়ার আগেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু করতে হয়েছে সরকারকে। কারখানাটি চালুর জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাসের ব্যবস্থাও নেই। পরীক্ষামূলকভাবে চালানোর জন্য যমুনা সার কারখানা বন্ধ করে নতুন কারখানায় গ্যাস দেওয়া হয়েছে।

সমস্যা আরও আছে। কারখানাটি থেকে সার সরবরাহের জন্য রেললাইন নির্মাণের কথা। কিন্তু রেললাইনের মূল কাজ এখনো শুরু হয়নি।

এরই মধ্যে ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা ১২ নভেম্বর উদ্বোধন করা হবে। এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা। গ্যাসের নিশ্চয়তা না থাকার পরও বিপুল ব্যয়ে কারখানা নির্মাণ, কারখানা চালুর আগের ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ ও একটি কারখানা বন্ধ রেখে আরেকটিতে গ্যাস সরবরাহের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

ঘোড়াশাল ও পলাশ সার কারখানাকে একীভূত করে ‘ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা’ প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১৮ সালে। তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। কারখানাটি ২০২২ সালের মধ্যে নির্মিত হওয়ার কথা। তবে মেয়াদ দুই দফা বেড়েছে। ব্যয় বেড়ে হয়েছে সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা।

কারখানাটি নির্মাণ করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প করপোরেশন (বিসিআইসি)। সংস্থাটির চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, নরসিংদীতে দুটি সার কারখানা ছিল। দুই কারখানার জন্য দিনে ৬ কোটি ৮০ লাখ ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যেত। সেই পরিমাণ গ্যাসের প্রাপ্যতা মাথায় রেখে নতুন সার কারখানা করা হয়। তিনি বলেন, তাঁরা চাওয়ার পর তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থা করেছে।

কিন্তু তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড গ্যাস দিচ্ছে যমুনা সার কারখানা বন্ধ করে। বিসিআইসির চারটি ইউরিয়া কারখানার একটি যমুনা। গ্যাস-সংকটের কারণে এখন চারটি কারখানাই বন্ধ। বিসিআইসি সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে চার কারখানায় ১০ লাখ মেট্রিক টন ইউরিয়া সার উৎপাদিত হয়। চাহিদা বছরে ২৬ লাখ টন। বাকিটা আমদানি করা হয়।

ঘোড়াশাল ও পলাশ সার কারখানাকে একীভূত করে ‘ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা’ প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১৮ সালে। তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। কারখানাটি ২০২২ সালের মধ্যে নির্মিত হওয়ার কথা। তবে মেয়াদ দুই দফা বেড়েছে। ব্যয় বেড়ে হয়েছে সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা।

জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন (জেবিআইসি), ব্যাংক অব টোকিও মিতসুবিশি ইউএফজে লিমিটেড এবং হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন লিমিটেডের (এইচএসবিসি) কাছ থেকে ১০ হাজার ৯২০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিসিআইসি কারখানাটি করেছে। বাকি ৪ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা সরকার দিয়েছে।

কারখানাটির জন্য বাণিজ্যিক ঋণ নেওয়া হয়েছে, যার সুদহার বেশি (সাড়ে ৪ শতাংশ)। শর্তও কঠিন। সাধারণত বিশ্বব্যাংক, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতো উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছ থেকে কম সুদে (২ শতাংশ) ঋণ পাওয়া যায়। শর্তও শিথিল থাকে।

নতুন কারখানায় বছরে ৯ লাখ ২৪ হাজার টন ইউরিয়া সার উৎপাদনের কথা রয়েছে, যা দেশের বার্ষিক চাহিদার প্রায় ৩৮ শতাংশ।

দৈনিক চাহিদা ৭ কোটি ২০ লাখ ঘনফুট গ্যাস

বিসিআইসি সূত্রে জানা গেছে, ঘোড়াশাল পলাশ সার কারখানা চালাতে দৈনিক ৭ কোটি ২০ লাখ ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন। গত ১২ অক্টোবর পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদন শুরুর পর এখন দিনে প্রায় ৬ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে যমুনা সার কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে ৪ কোটি ৩০ লাখ ঘনফুট।

ঘোড়াশাল পলাশ সার কারখানার প্রকল্প পরিচালক রাজিউর রহমান মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, উৎপাদনে যাওয়ার জন্য কারখানা প্রস্তুত। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না, এটা ঠিক। তবে প্রথম দিকে এত গ্যাস লাগবেও না। কারণ, চালুর পর শুরুর দিকে কারখানাটি সক্ষমতার ৬৫ শতাংশ ব্যবহার করা যাবে।

গত ১৭ আগস্ট অনুষ্ঠিত এই প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির ১৩তম সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, গ্যাস বিল বাবদ বিসিআইসির কাছে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা পাবে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। তিতাস সূত্র বলছে, বকেয়া পরিশোধ করতে না পারায় বিসিআইসিকে গ্যাস দেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ সতর্ক তারা।

তিতাসের মহাব্যবস্থাপক লুৎফুল হায়দার অবশ্য বকেয়া বিল নিয়ে কিছু বলেননি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাসের সংকট আছে। ঘোড়াশাল পলাশ সার কারখানায় চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস দেওয়া নিয়ে আলোচনা চলছে।

উৎপাদনে যাওয়ার জন্য কারখানা প্রস্তুত। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না, এটা ঠিক। তবে প্রথম দিকে এত গ্যাস লাগবেও না। কারণ, চালুর পর শুরুর দিকে কারখানাটি সক্ষমতার ৬৫ শতাংশ ব্যবহার করা যাবে।
ঘোড়াশাল পলাশ সার কারখানার প্রকল্প পরিচালক রাজিউর রহমান

রেললাইনের মূল কাজ শুরুই হয়নি

কারখানাটিতে উৎপাদিত সারের ৪০ শতাংশ রেলপথে পরিবহনের কথা। এ জন্য ঘোড়াশাল রেলস্টেশন পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করতে হবে।

প্রকল্প পরিচালক রাজিউর রহমান মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘রেললাইন নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়েকে আমরা ২৬৫ কোটি টাকা দিয়ে বসে আছি। কিন্তু কাজের কোনো খবর নেই।’

কারাখানা সূত্র জানায়, রেললাইনের মাত্র ২ কিলোমিটারের জন্য ঠিকাদার চূড়ান্ত করতে পেরেছে রেলওয়ে। বাকি অংশের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলেও ঠিকাদার চূড়ান্ত হয়নি।

বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী আবু জাফর মিঞা প্রথম আলোকে বলেন, বিসিআইসি ধাপে ধাপে টাকা দিয়েছে। টাকা পাওয়ার পর দরপত্র আহ্বান করা হয়। সে কারণে দেরি হচ্ছে। পুরো কাজ শেষ করতে অন্তত দুই বছর সময় লাগবে।

দেশের উন্নয়ন প্রকল্পে মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয়হীনতা প্রায়ই দেখা যায়। বিপুল ব্যয়ে এত বড় কারখানা করেও যদি ইউরিয়া আমদানি করতে হয়, তাহলে বিনিয়োগ নিয়েও প্রশ্ন উঠবে।
সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান

কিস্তি শোধ শুরু

কারখানাটি চালুর আগেই ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ শুরু হয়েছে বিসিআইসির ওপর। গত ১৩ সেপ্টেম্বর প্রথম কিস্তির ৫২২ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়। কারখানার কোনো আয় না থাকায় সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কাছে গিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এই টাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরের কিস্তি আগামী বছরের মার্চে পরিশোধ করতে হবে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দেশের উন্নয়ন প্রকল্পে মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয়হীনতা প্রায়ই দেখা যায়। বিপুল ব্যয়ে এত বড় কারখানা করেও যদি ইউরিয়া আমদানি করতে হয়, তাহলে বিনিয়োগ নিয়েও প্রশ্ন উঠবে।