বিজয় কি-বোর্ড যুক্ত করে স্মার্টফোন এখনো বাজারে ছাড়া শুরু করেনি উৎপাদন ও আমদানিকারক কোম্পানিগুলো। তারা জানিয়েছে, বিজয় কি-বোর্ড যুক্ত করে স্মার্টফোন বাজারে ছাড়তে খরচ বাড়বে। আরও কিছু সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যার কথা জানিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির কাছে সময় চেয়েছে তারা।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) গত ১৩ জানুয়ারি মুঠোফোন উৎপাদনকারী ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দিয়ে বলেছে, সব অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোনে বিজয় কি-বোর্ড যুক্ত করে বাজারে ছাড়তে হবে। নইলে মুঠোফোন বিক্রির অনাপত্তি দেওয়া হবে না। অবশ্য বিটিআরসি কোন আইনে এবং কার নির্দেশনায় বিষয়টি বাধ্যতামূলক করেছে, তার কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
বিটিআরসি বিজয় কি-বোর্ড বাধ্যতামূলক করার ৬ দিন পর ১৯ জানুয়ারি সংস্থাটিকে চিঠি দিয়ে সময় চায় মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। চিঠিতে বলা হয়, বিজয় অ্যান্ড্রয়েড প্যাকেজ কিট (এপিকে) ফাইল মুঠোফোনে স্থাপন (ইনস্টল) করে দিতে হলে তা পরীক্ষা করার জন্য সময় প্রয়োজন এবং বাড়তি বিনিয়োগ লাগবে।
বর্তমানে স্মার্টফোনে বিজয় বা অন্য যেকোনো প্রমিত বাংলা কি-বোর্ডের খুব একটা প্রয়োজন নেই।মোহাম্মদ এনামুল কবির, প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নবিষয়ক সাবেক পরিচালক, বিসিসি
অ্যান্ড্রয়েডের হালনাগাদ সংস্করণগুলোর (ভার্সন) জন্য সব এপিকে ফাইলও হালনাগাদ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বিটিআরসি বিজয় কি-বোর্ডের যে এপিকে ফাইল সরবরাহ করেছে, তা হালনাগাদ করা নয়। এ ফাইল অনেক মুঠোফোনে স্থাপন করতে গেলে তা ‘ক্র্যাশ’ করছে (কাজ করছে না)।
বিটিআরসিকে দেওয়া চিঠিতে আরও বলা হয়, কোনো এপিকে ফাইল অ্যান্ড্রয়েড মুঠোফোনে স্থাপন করতে গেলে গুগলের অনুমোদন লাগে। যেসব বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের মুঠোফোন দেশে উৎপাদিত হয়, সেসব মুঠোফোনে নতুন কোনো এপিকে ফাইল স্থাপন করতে গেলে প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন নিতে হয়।
মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব জাকারিয়া শহীদ প্রথম আলোকে বলেন, গুগলে দুটি প্যাকেজ আছে—একটি বিনা মূল্যের এবং আরেকটি ‘পেইড প্যাকেজ’ (কিনে নিতে হয়)। দেশীয় যেসব ব্র্যান্ড আছে, তারা বিনা মূল্যের প্যাকেজটি ব্যবহার করে। বিটিআরসির নির্দেশনা মানতে গেলে গুগলের ‘পেইড প্যাকেজ’ নিতে হবে। এতে দেশীয় কোম্পানির মুঠোফোন উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে।
বিটিআরসির চিঠির বৈধতার খোঁজে
বিটিআরসি বিজয় কি-বোর্ড ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার পর এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। এই কি-বোর্ডের মেধাস্বত্ব ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান আনন্দ কম্পিউটার্সের নামে। টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি প্রতিষ্ঠান মন্ত্রীর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের পণ্য বা সেবার নাম উল্লেখ করে তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার চিঠি দিতে পারে কি না, সেই প্রশ্নও ওঠে।
আরেকটি প্রশ্ন উঠেছিল, সেটি হলো কি-বোর্ড বিএসটিআইয়ের বাধ্যতামূলক পণ্য বা সেবা নয়। সেটি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা যায় কি না। অবশ্য টেলিযোগাযোগমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেছিলেন, বিজয় কি-বোর্ড বিনা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে। এখানে স্বার্থের সংঘাতের প্রশ্ন নেই।
বিটিআরসি বিজয় কি-বোর্ড বাধ্যতামূলক করে যে চিঠি দিয়েছে, তাতে ‘আদিষ্ট হয়ে’ এবং ‘সরকারের নির্দেশনা’র কথা উল্লেখ করা হয়েছে। চিঠির বিষয়ে শুরুতে সংস্থাটির কাছ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সে সময় বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর শিকদার বিদেশে ছিলেন। তিনি দেশে ফেরার পর গত ২৩ জানুয়ারি বিটিআরসির কার্যালয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, বিটিআরসির এই নির্দেশনায় অনুচিত কিছু হয়নি।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান তখন একটি কাগজ প্রথম আলোকে দেন, যেখানে কোন প্রেক্ষাপটে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা লেখা রয়েছে। বিজয় কি-বোর্ড ব্যবহারের পক্ষে যুক্তি হিসেবে বিটিআরসি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী আইসিটি বিভাগের নির্দেশনার কথা বলেছেন।
২০১৯ সালের ৬ মার্চ আইসিটি বিভাগ একটি চিঠি দেয়, যেখানে বলা আছে, বিসিসির (বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল) সহায়তায় বিএসটিআই তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য সম্প্রতি কিছু মান হালনাগাদ করেছে, যার তিনটিকে মান হিসেবে ঘোষণা করেছে বিএসটিআই। সরকারি পর্যায়ে চলমান ও ভবিষ্যৎ ডিজিটাইজেশন কার্যক্রমে তিনটি মান ব্যবহার করা প্রয়োজন।
আইসিটি বিভাগ এই চিঠিতে ‘বিজয়’ উল্লেখ করেনি এবং যে তিনটি মান ব্যবহারের কথা বলেছে, তা শুধু সরকারি পর্যায়ের কার্যক্রমে ব্যবহার বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়ে অনুরোধ করেছে। আইসিটি বিভাগের জ্যেষ্ঠ সিস্টেম অ্যানালিস্ট মো. নবীর উদ্দীনের স্বাক্ষরে চিঠিটি পাঠানো হয়। এ বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এটা সরকারি কাজের সুবিধার্থে করা হয়েছিল, কিন্তু বাধ্যতামূলক না।
‘এটা অযৌক্তিক’
বিজয় কি-বোর্ড প্রসঙ্গে বিটিআরসি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর ব্যাখ্যায় আইসিটি বিভাগের ভূমিকার কথা এসেছে। বিটিআরসি বলছে, তারা ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের নির্দেশনা মেনে এবং তাদের সরবরাহ করা বিজয় কি-বোর্ডের এপিকে ফাইল ব্যবহারের জন্য চিঠি জারি করেছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছিলেন, বিটিআরসি আইসিটি বিভাগের ‘মান মেনে চলতে বাধ্য’।
তবে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, বিজয় কি–বোর্ড বাধ্যতামূলকের এ সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক।
এ ছাড়া বাংলা কি-বোর্ডের কারিগরি মান নিয়ে কাজ করা সংস্থা বিসিসিও বলছে, তারা কোথাও ‘বিজয়’ বলেনি এবং বাধ্য করেনি। বিসিসি সূত্রে জানা যায়, তারা এখন কোনো একটি কি-বোর্ড বিন্যাসের (লে–আউট) ওপর নির্ভর করতে চাচ্ছে না; বরং বিন্যাসমুক্ত সফটওয়্যার তৈরি করছে। সংস্থার গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ প্রকল্প ‘ইউনিবোর্ড’ নামে একটি সফটওয়্যার তৈরি করেছে।
বিসিসির প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নবিষয়ক সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ এনামুল কবির ২০১৮ সালে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা প্রমিতকরণ কমিটির সদস্যসচিব ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে স্মার্টফোনে ‘বিজয়’ বা অন্য যেকোনো প্রমিত বাংলা কি-বোর্ডের খুব একটা প্রয়োজন নেই। ভয়েস কমান্ড (মুখে নির্দেশনা দেওয়া) ও অন্যান্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন স্মার্ট পদ্ধতির আবির্ভাবের ফলে কি-বোর্ডের প্রাসঙ্গিকতা ক্রমে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।