শিশুর পাশে, মনের যত্নে

শারীরিক অসুস্থতায় আমরা চিকিৎসা নিই। সুস্থ থাকার জন্য নিয়মিত যত্ন নিই শরীরের। কিন্তু মনের? মনও যে অসুস্থ হতে পারে, মনেরও যে যত্ন দরকার—এটা আমরা অনেকে জানি না। সামাজিক সচেতনতায় মনের যত্নের বিষয়টিতে এখন অনেকেই সচেতন হচ্ছেন। তবে তা অল্পসংখ্যক। তা ছাড়া অনেকে ভাবেন, মনের যত্ন শুধু বড়দের দরকার। শিশুদের যে মনের শুশ্রূষা দরকার, সেটা ভাবনাতে আনেন না।

ব্র্যাক আইইডির চাইল্ড থেরাপিস্ট মোস্তাক ইমরান জানান, ‘আমাদের শিশুরা খেলতে চায়। খেলার মাধ্যমে গল্পে গল্পে তারা শৈশবটা উপভোগ্য করতে চায়। কিন্তু সুযোগ পায় না। দেখা যাচ্ছে, আমাদের খেলার মাঠ নেই। শিশুরা অনেক রকম ডিভাইসে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন উৎসবে, পার্বণে তাদের খেলার সুযোগ করে দেওয়া উচিত। শিশুরা যেকোনো পরিবেশে খেলতে পারে। তার জন্য খুব বেশি অর্থকড়ির প্রয়োজন নেই।’ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক আয়োজিত ‘হোপ ফেস্টিভ্যালে’ শিশুদের খেলার জায়গায় উচ্ছলতা দেখে এসব কথা বলেন তিনি।

ব্র্যাকের ৫০ বছরের অগ্রযাত্রার অংশ হিসেবে ৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে শুরু হয়েছিল তিন দিনব্যাপী ‘হোপ ফেস্টিভ্যাল’। ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’, ‘সম্ভাবনার শক্তি’ ও ‘যে পৃথিবী আমরা গড়তে চাই’—এই তিন প্রতিপাদ্য সামনে রেখে সাজানো হয়েছিল তিন দিনের অনুষ্ঠানমালা। আয়োজন ছিল শিশুদের জন্য। কিন্তু নিজেদের হারিয়ে যাওয়া শৈশবের নির্মল আনন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন অনেক মা–বাবাসহ নানা বয়সী দর্শক।

এই আয়োজনে আসতে পেরে খুবই উচ্ছ্বসিত শিশু দর্শক আনিশা, ‘এখানে অনেক বড়রাও আমার সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, আমরা সবাই একই বয়সী, মানে ইকুয়াল।’

৫০ বছরে ব্র্যাকের নানা আশাজাগানিয়া গল্পের উদ্‌যাপন হোপ ফেস্টিভ্যালে অংশ নিয়ে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট (ব্র্যাক আইইডি) সাধারণ দর্শকদের মধ্যে এই বার্তা ছড়িয়ে দেয়—প্রতিদিনকার জীবনে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন অপরিহার্য।

ব্র্যাক আইইডির মনোবিজ্ঞানী নুসরাত জাহান বলেন, ‘মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া খুবই জরুরি। মানসিকভাবে যদি ভালো থাকি, তাহলে আমরা বর্তমানটা সুন্দরভাবে কাটিয়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে পারব। শুধু শিশুদের নয়, সব বয়সী মানুষের এমনকি গর্ভাবস্থায় মায়েদেরও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন প্রয়োজন।’

মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের বিভিন্ন কর্মশালায় বিশেষজ্ঞরা জানালেন, ‘মন নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই রাগ ও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। মন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না হলে সামাজিক মেলামেশায় আবেগের বহিঃপ্রকাশের সমস্যা হয়। ভিন্ন ভিন্ন বয়সী মানুষের মন নিয়ন্ত্রণ করে সমাজে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে মেলামেশা করা উচিত।’

এই আয়োজনে শুধু তাত্ত্বিক আলোচনাই নয়, ‘মাইন্ড ট্রি’ কেন্দ্র করে আয়োজিত বিভিন্ন কর্মশালার মাধ্যমে দর্শকেরা জানতে পারেন, মনের আছে ভালো আর খারাপ দিক। কী করলে মন ভালো থাকবে, তা সহজে বুঝতে সাজানো হয়েছিল আকর্ষণীয় ইমোজি। মানসিক চাপ ও রাগ নিয়ন্ত্রণসহ কীভাবে মা-বাবা নিজের যত্ন নেবেন, তা নিয়ে হয়েছে খোলামেলা আলোচনা।

আলোচনায় অংশ নিয়ে অনেকে পেয়েছেন মন ভালো রাখার নতুন দিশা। তেমনি একজন হলেন স্বর্ণা মিতা চৌধুরী। এই শিক্ষার্থী জানান, ‘হোপ ফেস্টিভ্যালের আয়োজনে কয়েকটা পরীক্ষণের মধ্য দিয়ে আমরা গিয়েছি। কীভাবে স্ট্রেস ম্যানেজ করা যায়, একজন শিক্ষার্থী হিসেবে এটা আমার কাছে খুব হেল্পফুল ছিল। আমার বাসায় ছোট ভাই আছে, তার সঙ্গে আমার কেমন আচরণ হওয়া দরকার—তা জানতে পেরেছি “হেলদি প্যারেন্টিং” সেশন থেকে। এই শিক্ষা আমার প্রতিদিনের জীবনে মানসিক স্বাস্থ্য মোকাবিলায় অনেক সাহায্য করবে।’

ব্র্যাক আইইডি ২০১৩ সাল থেকে প্রায় ৭০০ প্যারাকাউন্সেলরের মাধ্যমে দেশজুড়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য কাজ করছে। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটি প্যারাকাউন্সেলর তৈরি করছে। প্যারাকাউন্সেলরদের ভূমিকা হলো তারা কমিউনিটি থেকে নির্বাচিত নেতা। এই নেতারা তাঁদের এলাকার ভাষাগুলো বোঝেন।

প্যারাকাউন্সেলররা শিশু, কিশোর-কিশোরী, মা-বাবা—সবাইকে মানসিক স্বাস্থ্যসহায়তা দিয়ে থাকেন।

ব্র্যাক আইইডির শিশু মনোরোগ–বিশেষজ্ঞ তাইফুর ইসলাম বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন রকম শর্ট কোর্স আয়োজন করছি, যেখানে ইতিবাচক অভিভাবকত্ব, রাগ নিয়ন্ত্রণ কিংবা ব্যক্তি কীভাবে নিজেকে মনোসামাজিক সহায়তাকারী হিসেবে উন্নয়ন করবেন, তা নিয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। যার মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় সচেতন হবেন, দেশের মানুষ। যত্নশীল হবেন নিজেদের মনের স্বাস্থ্যের প্রতি।’