ক্যানসার চিকিৎসাবিষয়ক আলোচনা
দেশে ক্যানসার চিকিৎসার উন্নত গবেষণার জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত অর্থায়ন
‘২০১৪ সাল থেকে ফেব্রুয়ারিকে বিশ্বব্যাপী ক্যানসার প্রতিরোধ মাস হিসেবে পালন করা হয়। সারা বিশ্বে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে ক্যানসারকে বিবেচনা করা হয়। এ ছাড়া ক্যানসারে আক্রান্তের হার দিন দিন বেড়েই চলছে। ফলে ক্যানসার নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা, সেমিনার, বিভিন্ন অনুষ্ঠান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সচেতনতামূলক বার্তা, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ইত্যাদি চোখে পড়ার মতো।’ অনুষ্ঠানের শুরুতেই বলছিলেন উপস্থাপক নাসিহা তাহসিন।
সবার মধ্যে ক্যানসারবিষয়ক সচেতনতা তৈরিতে গত সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) এসকেএফ অনকোলজি আয়োজন করে ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা। এতে অতিথি হিসেবে ছিলেন জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহিদা আলম। এ পর্বে আলোচনার বিষয় ছিল ‘ক্যানসার বার্তা’। বাংলাদেশে ক্যানসারের বর্তমান অবস্থা, ডায়াগনোসিস, আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা, রোগনির্ণয় ও প্রতিরোধব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে পরামর্শ দেন ডা. শাহিদা আলম। পর্বটি সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।
শুরুতেই উপস্থাপক জানতে চান এবারের বিশ্ব ক্যানসার দিবসের প্রতিপাদ্য সম্পর্কে। উত্তরে ডা. শাহিদা আলম বলেন, এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘ইউনাইটেড বাই ইউনিক’। এখানে ইউনিক মানে ভিন্নতা বা স্বতন্ত্রতা বোঝানো হয়েছে। কারণ, প্রত্যেক মানুষ ভিন্ন। এ ভিন্নতা হতে পারে বয়সে, অর্থনৈতিক অবস্থানে এবং নারী-পুরুষে। কিন্তু লক্ষ্যের জায়গা থেকে সবাই কিন্তু এক বা ইউনাইটেড। তাই ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সবাই মিলে সেরা যত্নটা নিতে হবে।’
ক্যানসারের চিকিৎসা সম্পর্কে ডা. শাহিদা আলম বলেন, সাধারণত যত ধরনের ক্যানসার আছে, তার ৯০ শতাংশেরই মূল চিকিৎসা সার্জারির মাধ্যমে টিউমার অপসারণ করা। এর সঙ্গে কিছু চিকিৎসা রয়েছে, যেগুলো সার্জারিটাকে ফলপ্রসূ করে। সেগুলো হলো কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, হরমোনথেরাপি, ইমিনোথেরাপি এবং টার্গেটেড থেরাপি। রোগীর প্রয়োজন অনুসারে চিকিৎসক এ চিকিৎসাগুলো নিশ্চিত করেন।
বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ‘টেইলর চিকিৎসাপদ্ধতি’ সম্পর্কে জানতে চান উপস্থাপক। উত্তরে ডা. শাহিদা আলম বলেন, এটার আরেকটি নাম আছে, সেটা হলো ‘প্রিসিশন মেডিসিন’। এটি হলো ডিএনএ বা জিনের সমন্বয়ে চিকিৎসাপদ্ধতির আধুনিক রূপ। অর্থাৎ নির্ভুলভাবে ওষুধের সুপারিশ, সঠিক মাত্রা, অপ্রয়োজনীয় ওষুধ পরিহার, অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসার খরচ এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি এড়িয়ে চিকিৎসা। এ পদ্ধতির মূল লক্ষ্য একজন রোগীকে প্রথাগত ওষুধের পরিবর্তে রোগীর নিজস্ব জেনেটিক মেকআপ, মলিকুলার প্রোফাইল এবং তাঁর ব্যক্তিগত তথ্য বিবেচনা করে রোগনির্ণয় এবং সে অনুসারে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
চিকিৎসায় উপকারের পাশাপাশি ঝুঁকিও রয়েছে। ‘স্টেম সেল প্রতিস্থাপন’ প্রসঙ্গে ডা. শাহিদা আলম বলেন, স্টেম সেল ট্রান্সপ্ল্যান্ট রক্ত এবং অস্থিমজ্জার রোগের চিকিৎসা করে। যেমন লিউকোমিয়া, লিম্ফোমা এবং মাল্টিপল মায়লোমা। স্টেম সেল ট্রান্সপ্ল্যান্টের মূল লক্ষ্য হলো ক্ষতিগ্রস্ত বা অসুস্থ অস্থিমজ্জাকে সুস্থ স্টেম কোষ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা, যা পরবর্তী সময়ে নতুন, সুস্থ রক্তকণিকা তৈরি করে। তাই রোগীর প্রয়োজন অনুসারে যদি চিকিৎসাটা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে ঝুঁকির চেয়ে উপকারই বেশি পাওয়া যাবে।
ক্যানসার চিকিৎসার লং-টার্ম কনসিকুয়েন্সেস এবং রোগীর স্বাস্থ্যকর জীবনের ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে ডা. শাহিদা আলম বলেন, চিকিৎসাপদ্ধতি এখন আধুনিক। শুধু চিকিৎসার মাধ্যমে একজন ক্যানসারের রোগীকে ১০-১৫ বছর বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। ফলে এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়। জীবনের ওপর কিছু প্রভাব পড়ে। এগুলো অধিকাংশই সার্জারি এবং থেরাপি নেওয়া রোগীর সঙ্গে ঘটে। সে ক্ষেত্রে কালক্ষেপণ না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ক্যানসার-চিকিৎসায় মাল্টি ডিসিপ্লিনারি বোর্ডের গুরুত্ব সম্পর্কে ডা. শাহিদা আলম বলেন, এটার গুরুত্ব অনেক বেশি। ক্যানসার চিকিৎসা করতে গেলে এর পর্যায়টা জানা জরুরি। এটি জানার পর চিকিৎসার জন্য একটা বোর্ড গঠিত হয়। যেটাকে বলা হয় ‘মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি টিউমার বোর্ড’। যেখানে অনকোলজিস্ট, সার্জন, রেডিয়েশনিস্টসহ প্রয়োজনবোধে আরও অনেকে থাকেন। মূলত তাঁরাই চিকিৎসাপদ্ধতি নির্ধারণ করেন।
প্রসঙ্গক্রমে উপস্থাপক জানান, এসকেএফ অনকোলজি বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র ইউজিএমপি ও অ্যানভিজা ব্রাজিল অনুমোদিত প্ল্যান্ট। ক্যানসার চিকিৎসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ প্রসঙ্গে ডা. শাহিদা আলম বলেন, ক্যানসার চিকিৎসা একটা মাল্টিডিসিপ্লিনারি অ্যাপ্রোচ। তাই এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট টেকনিশিয়ান, মেডিকেল ফিজিসিস্ট, অনকোলজি, নার্স সবাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। কারণ, ক্যানসারের গবেষণা যত বাড়ছে, ততই নতুন চিকিৎসাপদ্ধতি এবং এ বিষয়ে নতুন সংকট তৈরি হচ্ছে। আগের জ্ঞান-অভিজ্ঞতা দিয়ে নতুন সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তাই সংশ্লিষ্টদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ।
ক্যানসার নিয়ে সামাজিক কুসংস্কার বা প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে ডা. শাহিদা আলম বলেন, এগুলো পুরোনো ব্যাপার। চিনি খাওয়া যাবে না, চুল পড়ে যাবে—এ জন্য অনেকে চিকিৎসা নিতে চান না। ক্যানসার ছোঁয়াচে রোগ, চিকিৎসা নিলে তাড়াতাড়ি মারা যাবে, অনেক টাকা লাগে, তাই কোনো চিকিৎসা না নেওয়া, বৈবাহিকসহ স্বাভাবিক জীবন যাপন করা যাবে না, প্রজননক্ষমতা কমে যায় ইত্যাদি। তাই এ ব্যাপারে পরিবারের সদস্যদের এবং চিকিৎসকদের সচেতনতা ও দায়িত্বশীল ভূমিকার মাধ্যমে মোকাবিলা করতে হবে।
বাংলাদেশ ক্যানসার চিকিৎসা গবেষণায় কতটুকু অগ্রসর হয়েছে? এ প্রসঙ্গে ডা. শাহিদা আলম বলেন, ‘সত্যি বলতে গবেষণায় আমরা বিশ্বের তুলনায় পিছিয়ে আছি। এর কারণ হলো, ক্যানসার চিকিৎসা দেওয়ার জন্য যে জনবল বিদ্যমান, তার প্রায় চার গুণ হলো রোগী। ফলে রোগীর সেবা নিশ্চিত করতে গিয়ে গবেষণার সুযোগটা পাওয়া যায় না। তাই সংশ্লিষ্টদের পাশাপাশি নীতিনির্ধারকদেরও প্রয়োজন এদিকে মনোনিবেশ করা। পাশাপাশি গবেষণার জন্য অর্থায়ন একটা গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক।’
ক্যানসার চিকিৎসায় বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্য ও বাধাগুলো কী? উত্তরে ডা. শাহিদা আলম বলেন, ‘স্ক্রিনিং, রোগীর সচেতনতা, স্থানীয় পর্যায়ে জনবল ও চিকিৎসাসেবা পর্যাপ্ত না থাকা, চিকিৎসার বিলম্বতা, অবকাঠামোগত অপ্রতুলতা ইত্যাদিতে পিছিয়ে আছি আমরা। তবে আশাবাদী, ক্যানসার চিকিৎসায় উন্নত বিশ্বের তুলনায় যে দিকগুলোতে আমরা পিছিয়ে আছি, সেগুলোতে এগিয়ে যাব।’