শিশুদের মুখে হাসি ফোটাতে চান ‘মায়াস্বরশিল্পী’ মানসুরা

মানসুরা মুবাশ্বিরার এক হাতে গ্র্যানি, আরেক হাতে টিটো
ছবি: রাইয়ান তালহা

মানসুরা মুবাশ্বিরার এক হাতে গ্র্যানি, আরেক হাতে টিটো। গ্র্যানি গান গাচ্ছে তো টিটো নিজের কথা বলতে চাইছে। সামনে বসা দর্শকেরা একই সঙ্গে মানসুরা, গ্র্যানি ও টিটোর তিন ধরনের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছেন। তবে কণ্ঠস্বর তিনটিই মানসুরার। শুধু তাঁর নিজের কথা বলার সময় মানসুরার মুখের নাড়াচাড়া দেখতে পান দর্শকেরা। গ্র্যানি ও টিটো যখন কথা বলে, তখন মানসুরার ঠোঁট বন্ধই দেখা যায়। পুতুল (পাপেট) গ্র্যানি ও টিটোর বয়স উপযোগী কণ্ঠও দেন মানসুরা।

মানসুরা মুবাশ্বিরা একজন ভেনট্রিলোকুইস্ট। বাংলায় বললে, তিনি একজন ‘মায়াস্বরশিল্পী’। তাঁকে শুধু তিনটি কণ্ঠস্বরে কথা বলতে হয় তা-ই নয়, গ্র্যানি (নানি) ও টিটোর (নাতি) শরীরের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে তাদের অঙ্গভঙ্গিও করাতে হয়। সামনে বসা দর্শকেরা, বিশেষ করে শিশুদের নানা বায়না থাকে গ্র্যানি ও টিটোর কাছে। সেগুলোও মেটাতে হয়। বায়না অনুযায়ী তাৎক্ষণিকভাবে স্ক্রিপ্ট বা কথামালাও সাজাতে হয়।

মানসুরা বলেন, ‘দীর্ঘক্ষণ কোনো অনুষ্ঠানে কথা বলার পর এমনও হয়েছে পাঁচ থেকে সাত দিন গলা দিয়ে আর কোনো কথাই বের হয় না। গলার যত্ন নিতে হয় সব সময়।’

মানসুরা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি বিভাগে পড়ছেন। বাবা মতিউর রহমান ও মা ফরিদা ইয়াসমিন দুজনই সরকারি চাকরিজীবী। বড় ভাই বর্তমানে সুইডেনে পড়াশোনা করছেন।

গ্র্যানি ও টিটোর কণ্ঠে কথা বলার সময় মানসুরা প, ফ, ব, ভ, ম—এসব অক্ষরকে বাদ দেন। তবে মানসুরার মতে, এভাবে কথা বলার কৌশলটি রপ্ত করা বেশ কঠিন। তাই চর্চা চালিয়ে যেতে হয়।

সম্প্রতি প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে মানসুরা তাঁর ভেনট্রিলোকুইস্ট হয়ে ওঠা এবং গ্র্যানি ও টিটোর গল্প বলেন। শখ পূরণের জন্য নিজে নিজে ভেনট্রিলোকুইস্ট হওয়ার বিভিন্ন ধাপ শিখেছেন। জানালেন, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এটি শেখার তেমন কোনো সুযোগ নেই। ভেনট্রিলোকুইস্ট বা মায়াস্বরশিল্পীদের কদরও তেমন নেই। তবে আস্তে আস্তে জনপ্রিয় হচ্ছে শিল্পের এই মাধ্যম। গ্র্যানি ও টিটো, বিশেষ করে গ্র্যানি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

মানসুরা জানালেন, ভেন্ট্রিলোকুইজম বা মায়াস্বর একধরনের শব্দশিল্প। বিশ্বব্যাপী ভেন্ট্রিলোকুইজমের চর্চা বেশ পুরোনো। মানসুরা জানালেন, তিনি যেসব স্টেজ শো বা অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন, সেখানে বিভিন্ন বয়সী দর্শক থাকেন। দর্শকদের কথা চিন্তা করে তিনি তাঁর গল্পটি সাজান। বিনোদন বা মজার মাধ্যমে মানসুরা বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা তৈরির কাজটিও করছেন।

মানসুরার সঙ্গে আলাপের ফাঁকে ফাঁকেই গ্র্যানি আর টিটোর খুনসুটি চলতে থাকে। গ্র্যানির বয়স হয়েছে, তবে সে তা মানতে নারাজ। কখনো শাড়ি পরে। কখনো সালোয়ার-কামিজ বা অন্য কোনো ফ্যাশনের জামা গায়ে দেয় সে। চশমাটাও বেশ বাহারি। গ্র্যানি গাইতে পারে। নাচতে পারে বলে দাবি করলেও পরে জানায় নাচতে গিয়ে অন্যদের পা ভেঙে দিয়ে এসেছে। কথা বলতে গিয়ে প্রায়ই মেজাজ দেখায়। আর গ্র্যানির নাতি টিটো সারা দিন মুঠোফোনে গেম খেলে। তবে যখন কথা বলে তখন সে জানায়, সে সারা দিন পড়াশোনা করে। এই মিথ্যা কথা বলার জন্য গ্র্যানির কাছে বকাও খায়।

শিশুদের নানা বায়না থাকে গ্র্যানি ও টিটোর কাছে। সেসব বায়না অনুযায়ী তাৎক্ষণিকভাবে স্ক্রিপ্ট বা কথামালাও সাজাতে হয় মানসুরা মুবাশ্বিরকে
ছবি: রাইয়ান তালহা

মায়াস্বরশিল্পী হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে মানসুরা জানালেন, বিষয়টা আসলে কি, পুতুল কীভাবে কথা বলছে—এসব নিয়ে বোঝানোর পর অনেকে জানতে চান, পুতুলের গায়ের ব্যাটারিটা কোথায় লাগানো? অর্থাৎ তাঁরা ধরেই নেন, ব্যাটারির সাহায্যে পুতুল কথা বলছে। এক অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে মানসুরা বলেন, অনুষ্ঠানের তখনো অনেক কিছু বাকি আছে। তবে মানসুরা বের হয়ে আসার সময় দর্শকদের মধ্যে, বিশেষ করে শিশুরা গ্র্যানি ও টিটোর পিছু পিছু অনুষ্ঠানস্থল থেকে বের হয়ে আসে। এতে অনুষ্ঠান আয়োজনকারীরা বেশ বিপাকে পড়ে যান।

শুরুর গল্প বলতে গিয়ে মানসুরা বলেন, মা-বাবা অফিসে চলে গেলে ইউটিউব ঘাঁটতেন। স্কুলে পড়ার সময়ই ইউটিউবে মানসুরা দেখেন ডার্সি লিন নামের ভেন্ট্রিলোকুইস্ট এক মেয়েকে নিয়ে পুরো যুক্তরাষ্ট্র মেতে আছে। ‘আমেরিকাস গট ট্যালেন্ট’-জয়ী ডার্সি লিনের বয়স তখনো কম। ডার্সি লিনের ভিডিওগুলো দেখা শুরু করেন মানসুরা। সত্যজিৎ রায়ের ‘ভূতো’ বইটিও পড়েন মানসুরা, এটি নবীন নামের ভেন্ট্রিলোকুইজম শিখতে আগ্রহী এক তরুণের গল্প।

মানসুরা জানালেন, ভেন্ট্রিলোকুইজম নিয়ে বাংলাদেশে কাজের পরিমাণ কম। তারপরও ইন্টারনেটে যেখানে যা পেয়েছেন পড়েছেন, জেনেছেন। করোনার সময় মানসুরা মুখ বন্ধ করে বা মুখ না নাড়িয়ে কথা বলার কৌশল রপ্ত করতে থাকেন। বাসায় যেসব পুতুল ছিল, সেগুলো হাতে নিয়ে আয়নার সামনেই চলতে থাকে এই চর্চা। বাংলাদেশে বিভিন্ন পাপেট বা পুতুল পাওয়া যায়। তবে মানসুরা যেমন চাচ্ছিলেন, তা পাচ্ছিলেন না। মানসুরার বাবা একবার যুক্তরাষ্ট্রে গেলেন। সেখান থেকে ফেরার সময় গ্র্যানি ও টিটোকে নিয়ে এলেন। করোনায় ঘরে আটকে থাকার সময়টাকে কাজে লাগান মানসুরা। ইউটিউব চ্যানেল খুলে গ্র্যানি ও টিটোকে নিয়ে ভিডিও বানানো শুরু করেন। মানসুরা বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পছন্দ করেন। বেসরকারি টেলিভিশন এনটিভির রিয়েলিটি শো ‘জিপিএইচ ইস্পাত অনন্য প্রতিভা’ প্রতিযোগিতায় মানসুরা অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হন। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুবাদে পাঁচ লাখ টাকা পান। এতেও উৎসাহটা অনেকখানি বেড়ে যায়। এখন বিভিন্ন টেলিভিশন ও অনুষ্ঠান থেকে ডাক পান মানসুরা। তবে কষ্টকর কাজটা করার জন্য অনুষ্ঠান আয়োজনকারীদের অনেকেই সম্মানী দেওয়ার বিষয়টিতে এখনো ততটা গুরুত্ব দেন না।

মানসুরা জানালেন, তাঁর এই কাজে পরিবারের সদস্যরা সার্বিকভাবে সহায়তা করছেন। গ্র্যানি-টিটোর জামা কাপড় বানিয়ে দেন মানসুরার মা। যেকোনো ভিডিও করে মানসুরা আগে তা পরিবারের সদস্যদের দেখান, তারপর তা ইউটিউবে আপ করেন।

মানসুরা গান করেন, নাচেন, ছবি আঁকেন, হারমোনিকা বাজান। বই পড়ার অভ্যাস তো আছেই। মানসুরা প্রথম আলোর কিশোর আলো বুক ক্লাবেরও সদস্য ছিলেন।

গ্র্যানি ও টিটোর কণ্ঠে কথা বলার সময় মানসুরা প, ফ, ব, ভ, ম—এসব অক্ষরকে বাদ দেন। তবে মানসুরার মতে, এভাবে কথা বলার কৌশলটি রপ্ত করা বেশ কঠিন। তাই চর্চা চালিয়ে যেতে হয়।

গ্র্যানি ও টিটোকে নিয়ে বা মায়াস্বরশিল্পী হিসেবে মানসুরা অনেক কিছু করার স্বপ্নও দেখেন। জানালেন, শহরের শিশুদের চেয়ে গ্রামের শিশুরা বা পথশিশুরা গ্র্যানি ও টিটোকে দেখে নির্মল আনন্দ পায়, তার তুলনা হয় না। এসব শিশুকে বিনোদন দিতে চান মানসুরা। একই সঙ্গে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি থাকা শিশুদের খেলনা উপহার দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে এসব শিশুর মুখে হাসি ফোটাতে চান।